আজকের আমাদের আলোচনার বিষয় – জীবন ও জীবিকার জন্য আর্থিক ভাবনা। আর্থিক ভাবনা থাকাটা খুবই জরুরী। নিজের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যকে গোছাতে ও জীবন নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে এই পাঠটি অত্যন্ত জরুরী।
Table of Contents
আর্থিক ভাবনা
আর্থিক ভাবনা
তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ, পিপীলিকা ছয় পা দিয়ে খাবারের সন্ধানে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। কী যে পরিশ্রম করে তারা খাবার মুখে করে বয়ে নিয়ে যায় নিজের ঠিকানায়। দীর্ঘ ছয় মাস ধরে তারা এ কাজ করতে থাকে আগামী ছয় মাসের খাবার জোগাড় করার জন্য। কী কষ্টই না পিঁপড়েরা করে একটি নিশ্চিন্ত আগামীর জন্য! এসো, পিঁপড়ে ও ফড়িং নিয়ে ঈশপের একটি গল্প পড়ি-
‘গ্রীষ্মের এক চমৎকার দিনে ঘাসফড়িং ভার ভায়োলিনটি নিয়ে গান গাইছিল, নাচছিল আর খেলা করছিল মনের আনন্দে। হঠাৎ সে দেখতে পেল একটা পিঁপড়া অনেক কষ্ট করে খাবার বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঘাসফড়িং পিঁপড়াকে বলল, ‘এত কষ্ট করছ কেন ভাই? এসো আমরা খেলা করি, গান গাই, নাচি’।
পিঁপড়া বলল, ‘আমাকে অবশ্যই এখন শীতের জন্য খাবার সঞ্চয় করে রাখতে হবে। তুমিও সময় নষ্ট না করে খাবার সংগ্রহ করে রাখো বন্ধু।। “আরে শীতকাল আসতে তো এখনও অনেক দেরি, ওসব নিয়ে চিন্তা করো না:- ঘাসফড়িং হাসতে হাসতে জবাব দিলো। পিঁপড়া কোনো কথা না বলে খাবার নিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা হলো। গ্রীষ্মশেষে শীত এলো জাঁকিয়ে। ক্ষুধায় কাতর ঘাসফড়িং কাঁপতে কাঁপতে পিঁপড়ার বাড়ি এলো।
“আমায় কিছু যেতে দেবে ভাই”- ঘাসফড়িং বলল পিঁপড়াকে। পিঁপড়া বলল, ‘অপেক্ষা করো আজ তোমায় দিচ্ছি। তবে কাল থেকে তোমার যাবার কিন্তু তোমাকেই যোগাড় করতে হবে। তুমি যদি সেদিন আমার কথা শুনতে, তাহলে আজ তোমাকে আমার কাছে আসতে হতোনা আর ক্ষুধায় কষ্ট পেতে হতোনা’।
সঞ্চয়
তোমাদের একটু পুরোনোদিনে ফিরিয়ে নিই। এই অঞ্চলে একসময় মায়েরা রান্নার জন্য প্রতিবেলায় যে চালটুকু লাগতো তা হাড়িতে নেয়ার পর সেখান থেকে একমুট চাল আলাদা পাত্রে/কলসে তুলে রাখতেন। এভাবে রোজ রাখতে রাখতে মাসশেষে ঐ পাত্রে অনেকখানি চাল জমে যেত। সেটা হতো তাদের সঞ্চয়। তখনকার দিনে মায়েরা সংসারের অনেক বিপদ পার করতেন এই মুটচালের সঞ্চয় দিয়ে।
সঞ্চয়ের কথা বলতে গেলে শুরুতেই আসে আয়ের কথা। মানুষ বিভিন্ন উপায়ে আয় করতে পারে, যেমন- কোনো নির্দিষ্ট কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক হিসেবে, ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে, কোনো পণ্য বা সেবা উৎপাদন করে এর বিনিময় করে ইত্যাদি। তোমরা কি আয় করো? কি মনে হয় তোমাদের?
চিত্র – মাটির ব্যাংকে সঞ্চয়
হ্যাঁ, তোমরাও আয় করো, তবে তোমাদের আয়ের ধরন হয়তো ভিন্ন। এই যেমন ধরো, তোমাদের বৃত্তি/ উপবৃত্তির টাকা, টিফিনের টাকা, ঈদ-পূজায় প্রাপ্ত সেলামি / প্রণামির টাকা, জন্মদিন বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে পাওয়া ঢাকা ইত্যাদি।
আবার, তোমাদের কেউ কেউ নিজেরা বিভিন্ন কাজ করেও অর্থ উপার্জন করতে পারো; যেমন- ইউটিউবে নিজের তৈরি বিভিন্ন সৃজনশীল কনটেন্ট আপলোড করে, জমিতে চাষের কাজে সাহায্য করে, দোকানে কাজ করে, নিজের বানানো মজার খেলনা বিক্রি করে ইত্যাদি উপায়ে অনেকেই ঢাকা আয় করে থাকো। উপহার হিসেবে বা অন্য কোনো উপায়ে প্রাপ্ত অর্থ হয়তো তোমরা মনের সুখে খরচ বা বায় করে ফেলো।
কখনো মজার কোনো খাবার কিনে খাও, কখনো হয়তো খেলনা কিনে খরচ করো কিংবা বেড়াতে যাও ইত্যাদি। এতে তোমাদের হাতে আর কোনো টাকাই অবশিষ্ট থাকে না। যদি কোনো বিশেষ প্রয়োজনে তোমাদের কিছু কিনতে হয়, তাহলে কী করবে বলো তো। আমাদের কিছু প্রয়োজন হলে আমরা সাধারণত মা- বাবা কিংবা ভাই-বোনদের কাছে চেয়ে নিই, কিন্তু ধরো, তোমার নিজের কাছে যদি কিছু টাকা গচ্ছিত থাকে, তাহলে তো তুমি ওই টাকা দিয়েই তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসটি কিনতে পারতে, তাই না?
আমরা যখন কোনো প্রয়োজন মেটাতে কিছু কেনাকাটা করি, তখন আমাদের আয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ কমতে থাকে। এভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা যে আয় করি তা থেকে ব্যয়ের পর অবশিষ্ট যে অর্থ থাকে, তা-ই সঞ্চয়। অপচয় পরিহার করে, মিতব্যায়ী হয়ে অর্থ সাশ্রয় করাটাও কিন্তু সঞ্চয়ের মধ্যে পড়ে । মনে করো, গত ঈদ বা পূজায় তুমি ১০০ টাকা উপহার পেয়েছ, ওটা তোমার আয়।
এখন ওই টাকা থেকে তুমি যদি ৫০ টাকা দিয়ে কোনো খেলনা কিনে থাকো, তারপরও তোমার কাছে ৫০ টাকা জমা থাকছে, এটা হলো তোমার সঞ্চয়। আর যদি পুরো টাকাই খরচ করে ফেলো, তাহলে কিছুই সঞ্চয় থাকল না।
এবারে তোমরা একটু মনে করে দেখো তো, গত এক বছরে তোমাদের কেউ কোনো টাকা আয় করেছ কিনা? যেমন- সেলামি/ প্রণামি/উপহার হিসেবে, যাতায়াতের বা টিফিনের খরচ বাবদ, নিজের লাগানো গাছের সবজি বা ফল অথবা নিজের পালিত হাঁস/মুরগির ডিম বিক্রয় ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত আয়। তোমাদের এই আয় করা টাকা তোমরা কীভাবে খরচ বা ব্যয় করেছো? অথবা কত টাকা সঞ্চয় করতে পেরেছো।
বিভিন্ন উপায়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা যে আয় করি, তা থেকে ব্যয়ের পর অবশিষ্ট যে অর্থ থাকে, তা-ই সঞ্চয়। প্রতিদিনের কাজকর্মের মধ্য দিয়েও আমরা সঞ্চয়কে বুঝতে পারি। যেমন ধরো, তোমার এলাকাটি পৌরসভার আওতায় পড়েছে। সেখানে প্রতিদিন নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে লাইনে পানি সরবরাহ করা হয়। আমরা তখন সারা দিনের জন্য পানি ধরে রাখি। যখন লাইনে পানি থাকে না তখন আমরা সেই জমানো পানি খরচ করি।
প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে এভাবে পানি জমিয়ে রাখাই হলো সঞ্চয়। বাড়িতে অপ্রয়োজনে প্রায়ই আমরা বাতি, ফ্যান ও গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখি। অথচ সেগুলো প্রয়োজন শেষ হওয়া মাত্রই বন্ধ করে রাখা উচিত। তাহলে সেটা হবে আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঞ্চয়।
সব সময় একটা কথা মনে রাখবে, আমাদের আয় ব্যয় যা-ই হোক না কেন, সেটা অবশ্যই বাবা-মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের জানাব। আমাদের হাতে কখন, কোথা থেকে কত টাকা এল এবং সেগুলো কীভাবে খরচ করলাম কিংবা জমালাম জমানো বা সঞ্চিত অর্থ কীভাবে খরচ করা বা কাজে লাগানো যায় তা তাদেরকে জানানোর পাশাপাশি তাদের পরামর্শও নিতে পারি। এতে তারাও আমাদের ওপর অনেক খুশি থাকবেন। সুতরাং তাদের না জানিয়ে কোনো কাজ করা একদম ঠিক হবে না। তাদের কাছে আমাদের সব সময় স্বচ্ছ থাকতে হবে।
এবার এসো, আমরা একটু হিসাব-নিকাশ করি। তোমাদের জীবন ও জীবিকা খাতায় নিচের ছকটি এঁকে নাও। ছকে তোমার আয় ও ব্যয় লিখে রাখবে। বাম পাশে অবশ্যই তারিখ লিখবে। এমন হতে পারে, পুরো মাসে কেউ হয়তো এক টাকাও হাতে পেলে না, তা নিয়ে একদম মন খারাপ করবে না। পরের মাসের জন্য অপেক্ষা করো। যখন টাকা হাতে পাবে, তখন লিখবে। মনে রাখবে, খরচের খাত নির্বাচনে প্রয়োজন ও পছন্দ বিবেচনায় রাখতে হবে।
ছক – আর্থিক ডায়েরি
সঞ্চয়ের গুরুত্ব
চিত্র – ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে একসময় বড় সুযোগ তৈরি হয়।
রামুর স্বপ্ন
রামুদের বাড়ি কক্সবাজারের উখিয়ায়। ওর বাবা সাগরে মাছ ধরেন। সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে যা টাকা পান, তার সবটুকু দিয়েই তিনি চাল-ডাল ইত্যাদি কেনেন। এভাবেই তাদের খাওয়া-পরা চলে। রামুর খুব শখ স্কুলে যাওয়ার, কিন্তু ওর বাবা ওকে সঙ্গে করে সাগরে নিয়ে যান। বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে রামুও মাঝে মাঝে দু-চারটি মাছ ধরে। ও তার বাবার কাছে আবদার করে বলে, ‘এই মাছ ব্যাগগুন কিন্তু আর (এই মাছগুলো কিন্তু আমার)।’
ওর বাবা হেসে বলেন, ‘এই ওগগা মাছ দিয়েরে তুই কী গরীবি দে (তুই কী করবি এই একটা মাছ দিয়ে)?” রামু মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “কিয়াল্লাই অবাজি, বেচুম আর টিয়া দিয়েরে মজা গরি খাইয়ুম দে (কেন বাবা! বেচব আর টাকা দিয়ে মজা খাবো!” কিন্তু আসলে রামু একটা টাকাও নষ্ট করে না। ওর ধরা মাছগুলো বাজারে বিক্রি করে টাকাটা সে তার মায়ের হাতে তুলে দেয় জমা রাখার জন্য। এরই মধ্যে একদিন সাগরের ঝড়ের তোড়ে ওদের ঘরের চালা উড়ে যায়।
রামুর বাবার তো মাথায় হাত। মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে কোথায়! এগিয়ে আসেন রামুর মা। একটু একটু করে এতদিনের জমানো টাকাগুলো বের করে আনেন। টিন কিনে মেরামত করেন তাদের সেই ঘর। রামুর বাবা ভাবেন, কোথা থেকে এল এই টাকা। সব শুনে তিনি রামুর ওপর খুব খুশি হন।
ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘ও বাপ, তর আজিয়ার তুন আর দরিয়ার যন ন পরিব, তুই এখনত তুন স্কুলত যাবি। আর আই প্রত্যদিন ১০ টিয়া গরি তোর কাছত জমা রাখি দিয়ুম বাজান (বাবা, আজ থেকে তোকে আর সাগরে যেতে হবে না, তুই স্কুলে যাবি। আর আমি প্রতিদিন ১০ টাকা করে তোর কাছে জমা রাখব)। ‘
ক) তোমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সঞ্চয়ের সুবিধাগুলো উল্লেখ করো।
খ) সঞ্চয় না করলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে বলে তোমরা মনে করো?
সঞ্চয় বিপদের বন্ধু। দুর্যোগ বা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে, ব্যক্তির আয় বন্ধ হয়ে গেলে বা সম্পদ বিনষ্ট হলে, হঠাৎ করে অর্থের প্রয়োজন হতে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে এমনকি মৌলিক চাহিদা পূরণ করাও কষ্টকর হয়ে যায়। এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সঞ্চয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের বিভিন্ন ইচ্ছা পূরণের জন্যও সঞ্চয় করা প্রয়োজন। মা দিবসে কিংবা বাবা দিবসে অথবা ভাই-বোন, বন্ধুদের জন্মদিনে আমরা বিভিন্ন উপহার দিতে চাই।
হতে পারে সেটা নিজ হাতে বানানো কোনো জিনিস কিংবা কিনে দেওয়া কিছু। তবে উপহার বানিয়ে কিংবা কিনে দিতে হলে আমাদের কিছু না কিছু টাকা প্রয়োজন। এই টাকা আমরা সঞ্চয়ের মাধ্যমে পেতে পারি। এ ছাড়া বই, খেলনা বা পছন্দের ব্যাগ ইত্যাদি কিনতে আমাদের সঞ্চয়ের টাকা কাজে লাগাতে পারি। আবার মা-বাবারও অনেক সময় টাকার প্রয়োজন হয়।
তখন যদি ছোটরা নিজেদের সঞ্চয় থেকে তাদের সাহায্য করতে পারে, তবে সেটা অনেক সময় যেমন গর্বের হয়, তেমনি মা-বাবার জন্য। অনেক উপকার হয়। যেকোনো বয়স থেকেই সঞ্চয় করা যেতে পারে সঞ্চয়ের জন্য মূল বিষয় হলো ইচ্ছে এবং সঞ্চয়ের কৌশল সম্পর্কে অবগত হওয়া এখন থেকেই আমাদের সঞ্চয়ী হতে হবে।
এসো সঞ্চয় করি
প্রায় শত বছর আগে সঞ্চয় করার একটি সহজ ও ঝামেলাহীন কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন জাপানি এক নারী। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘কাকেইবো’। এর অর্থ হলো পারিবারিক আর্থিক খতিয়ান। কাকেইবোতে হিসাব- নিকাশ রাখা হয় কাগজ-কলমে অর্থাৎ আর্থিক ডায়েরিতে। কাকেইবো অনুসরণে কোনো কিছু কেনার আগে নিজেকে কিছু প্রশ্ন করতে হবে-
- যা কিনতে চাই, তা কেনার মতো টাকা/অর্থ আছে কিনা
- যা কিনব তা আসলেই ব্যবহার করা হবে কিনা
- সেটি এখনই কেনার প্রয়োজন আছে কিনা
- সেটি সত্যিই কাজে লাগবে কিনা
- না কিনলে কোনো ক্ষতি আছে কিনা।
- এই মুহূর্তে না কিনলে চলবে কিনা
কোনো কিছু কেনার আগে নিজেকে উপরের প্রশ্নগুলো করলে হয়তো তুমি যা কিনতে চাচ্ছ তা কেনার যৌক্তিক কারণ জানতে পারো অথবা কেনার ইচ্ছা ত্যাগও করতে পারো। ফলে অযৌক্তিক বা অযথা যা ব্যয় করতে যাচ্ছিলে তা পরিণত হবে তোমার সঞ্চয়ে। এ কারণে আমাদের সব সময় কোনটি মৌলিক প্রয়োজন তা ভেবে দেখতে হবে।
নিজেদের অযাচিত ইচ্ছা পূরণের জন্য আমরা অনেক সময় নিজেদের কিছু বদ অভ্যাস গড়ে তুলি, যেমন- জাঙ্ক ফুড খাওয়া, রাস্তা থেকে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, অপ্রয়োজনীয় কেনা কাটা করা বা সামনে কিছু দেখলেই কেনার জন্য ছটফট করা ইত্যাদি। আবার তোমাদের কারও কারও থাকতে পারে অনেক ধরনের বিলাসিতা, যেমন- ঘন ঘন নতুন জামা-কাপড়-জুতা কেনা কিংবা নানা রকম ভিডিও গেম, বন্ধুদের জন্য দামি গিফট ইত্যাদি কেনা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। এ জন্য মনে রাখবে-
চিত্র – সঞ্চয় সিগন্যাল
স্কুল ব্যাংকিং
তোমরা এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ কীভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় একসময় বড় সঞ্চয়ে পরিণত হয়। আর এই সঞ্চয় তোমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে। তোমাদের সঞ্চয় অনেকেই হয়তো মাটির ব্যাংকে রেখেছ। বিভিন্ন আকারের ও আকৃতির মাটির ব্যাংক অনেক সময় আমরা মেলা থেকে কিনে থাকি। এর মধ্যে আম, গাড়ি, হাতি এমনকি ডোরাকাটা বাঘের পুতুলকে আমরা পয়সা রাখার মাটির ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে থাকি।
অনেকে আবার বইয়ের পাতায় কিংবা বাঁশের খুঁটির মধ্যেও টাকা এবং কয়েন সংরক্ষণ করে থাকে। একবার ভাবো তো, এভাবে টাকা রাখা কতটা নিরাপদ! এমন হতে পারে, বইটি হারিয়ে গেল কিংবা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কোথায়ও পড়ে গেল! মাটির ব্যাংক হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল অথবা ধরো, বাঁশের খুঁটিতে রাখা টাকা কোনো পোকায় কেটে ফেললা আবার এখানে সেখানে টাকা রাখলে, অনেক সময় তোমরা ভুলেও যেতে পারো কোথায় রেখেছ।
কিংবা ধরো, জামা বা প্যান্টের পকেটে রেখেছ আর সেটি ধোয়ার সময় ভুলে গেলো তখন তোমার জমানো টাকার কী হাল হবে বলতো? কিন্তু তোমরা যদি নিরাপদে তোমাদের সঞ্চয়গুলো রাখতে চাও, তাহলে কোথায় রাখা যায় তা একটু ভেবে দেখো তো! এসো, এবার শিক্ষকের দেওয়া নির্দেশনা মোতাবেক কোন ধরনের সংরক্ষণে কী সমস্যা বা সুবিধা তা ভালোভাবে বুঝে নীচের ছকটি পূরণ করি।
ছক – সঞ্চয় সংরক্ষণের উপায়
ছক পূরণ করে তোমরা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছ, ব্যাংকে অর্থ জমা রাখাই সবচেয়ে নিরাপদ।
বাড়ির বড়দের মধ্যে কাউকে হয়তো তোমরা ব্যাংকে টাকা রাখতে দেখো, তাই না? তোমরা কি জানো, তোমাদের জন্যও ব্যাংকে টাকা রাখার ব্যবস্থ্যা আছে? ১৮ বছরের কমবয়সী যেকোনো শিক্ষার্থী তাদের মা-বাবা অথবা আইনগত অভিভাবকের সহায়তায় যেকোনো ব্যাংকে হিসাব/অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। উক্ত অ্যাকাউন্টে সহজেই একজন শিক্ষার্থী তার সঞ্চয়ের অর্থ জমা রাখতে পারবে।
মাত্র ১০০ টাকা জমা করেই তোমরা এ সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে পারবে। তোমাদের পক্ষে মা-বাবা অথবা আইনগত অভিভাবক এই হিসাব পরিচালনা করতে পারবেন। তোমাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে তোমাদের সম্মতিতে এই হিসাব সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। মজার বিষয় হলো, স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য এই ব্যাংকিং সচল রাখার জন্য কোনো (সরকারি ফি ব্যতীত) প্রকার সার্ভিস চার্জ/ ফি দিতে হয়না এবং আকর্ষণীয় লভ্যাংশ/মুনাফা প্রদান করা হয়।
এই হিসাবে তোমরা তোমাদের সঞ্চয়ের অর্থ জমা রাখার পাশাপাশি বৃত্তি/উপবৃত্তির অর্থও সংগ্রহ করতে পারবে। তোমাদের সঙ্গে ব্যাংকের এই হিসাব বা অ্যাকাউন্ট ও লেনদেন ব্যবস্থার নামই হলো স্কুল ব্যাংকিং। স্কুল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা অনেক। এসো একনজরে দেখে নিই সুবিধাগুলো-
চিত্র – স্কুল শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় !
- জমানো টাকা নিরাপদে থাকবে;
- জমানো টাকার ওপর ব্যাংকের প্রদত্ত আকর্ষণীয় লভ্যাংশ/মুনাফা যোগ হবে;
- এটিএম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে প্রয়োজনে যেকোনো স্থানের এটিএম বুথ থেকে টাকা উঠানো যাবে;
- স্কিম ডিপোজিট করে জমানো টাকায় দীর্ঘমেয়াদি ও লাভজনক সঞ্চয় করা যাবে;
- বৃত্তি/উপবৃত্তির টাকা গ্রহণ করা যাবে;
- ঝামেলাহীন উপায়ে স্কুলের বেতন/ফি পরিশোধ করা যাবে;
- শিক্ষা বীমা সুবিধা গ্রহণ করা যাবে;
- প্রয়োজনে ঋণ সুবিধাও গ্রহণ করা যাবে ইত্যাদি।
এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, টাকা জমানোর জন্য কেন স্কুল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করানো হলো? এবার এসো, ছোট একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করি-
সত্যের বাবা জনাব সাগর সরকার মাসে ২০,০০০.০০ টাকা করে বেতন পান এবং প্রতিমাসে সংসারে তার ১৮,৫০০.০০ টাকা খরচ হয়। প্রতি মাসে তার সঞ্চয় কত তা হিসাব করে বের করো। কিন্তু তিনি সঞ্চিত অর্থ জমিয়ে না রেখে এটা-সেটা কিনে খরচ করে ফেলেন। তবে তিনি এভাবে সঞ্চিত এক বছরের অর্থ নিকটস্থ ব্যাংকে জমা রাখলে ৭% লভ্যাংশ পেতেন। যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে ৫ বছর পর তার সঞ্চিত অর্থ বৃদ্ধি পেয়ে কত হতো, বলতো? এরকম একটি পরিস্থিতিতে সাগর সরকারের জন্য কিছু পরামর্শ দাও।
এসো কিছু কেনার জন্য একটি আর্থিক পরিকল্পনা করি
কোনো কিছু কিনতে গেলে প্রথমেই আমরা চিন্তা করি কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি কিনতে কত টাকা লাগতে পারে। এরপর চিন্তা করি সেটি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা আমার নিকট আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে বাড়তি আর কত টাকা কীভাবে সংগ্রহ করতে হবে, সবকিছুরই একটা সম্ভাব্য হিসাব আমরা করে থাকি। এটিই হলো, কিছু কেনার আর্থিক পরিকল্পনা। এখন কথা হলো আর্থিক পরিকল্পনা কেন প্রয়োজন।
এখন থেকেই যদি আমরা আর্থিক পরিকল্পনা করে কাজ করতে শিখি, তবে ভবিষ্যৎ কর্মজীবন ফলপ্রসু সুন্দর হতে পারে। এখন আমরা দেখব, কিছু কেনার জন্য আর্থিক পরিকল্পনা কীভাবে করা যেতে পারে, যেমন- ধরো, তোমার অনেক দিনের শখ একটি সুন্দর ক্যারম বোর্ড কেনার। এদিকে বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। হেঁটে যেতে বেশ সময় নষ্ট হয়। এবার তুমি হয়তো চিন্তা করে ঠিক করলে, ক্যারমের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সাইকেলের।
অর্থাৎ তুমি সাইকেল কেনার সিদ্ধান্ত নিলে। এবার তোমাকে সাইকেল কেনার পরিকল্পনা করতে হবে। এ জন্য প্রথমেই দেখতে হবে তোমার কাছে অথবা তোমার স্কুল ব্যাংকিং হিসাবে কত টাকা সঞ্চিত আছে। সাইকেলটি কিনতে আর কত টাকার প্রয়োজন। বাকি অর্থ তুমি কীভাবে সংগ্রহ করবে তা তোমাকে চিন্তা করতে হবে। এবার তুমি বিভিন্ন উৎসবে বড়রা তোমাকে যে উপহার দেয় কিংবা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে, রিকশায় না উঠে হেঁটে স্কুলে গিয়ে তুমি অল্প অল্প করে অর্থ সংগ্রহ করতে থাকলে।
তোমার সঞ্চিত অর্থ স্কুল ব্যাংকিংয়ের সঞ্চিত হিসাবে জমা করতে থাকলে।এভাবে সঞ্চিত অর্থ একসময় সাইকেলের মূল্যের সমপরিমাণ হলো। এরপর বাবাকে নিয়ে একদিন ব্যাংকে গেলে এবং সঞ্চিত অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে বাজারে গিয়ে তোমার পছন্দের সাইকেলটি কিনলে। এভাবে আর্থিক পরিকল্পনা করে আমরা আমাদের ইচ্ছা বা স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপদান করতে পারি। কিছু কেনার আর্থিক পরিকল্পনা করার সময় আমরা কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে পারি।
কিছু কেনার জন্য আর্থিক পরিকল্পনার ধাপ
অর্থাৎ মূল কথা হলো, আমাদের অনেক ধরনের পছন্দ থাকতে পারে। সেখান থেকে প্রয়োজন বিবেচনা করে যেকোনো একটিকে আমরা বেছে নেব। এরপর সেটির জন্য কত টাকা লাগবে, কবে নাগাদ কিনতে চাই এবং প্রতিমাসে কত টাকা করে জমা করতে হবে তা হিসাব করে বের করব। সেই অনুযায়ী ব্যাংকে টাকা জমাতে থাকব।
জমানো টাকার সঙ্গে ব্যাংকের বার্ষিক লভ্যাংশ হিসাবে জমা হয়ে একসময় দেখব আমার কাঙ্ক্ষিত টাকার পরিমাণ জমা হয়ে গেছে। ব্যস, কিনে ফেলব আমার স্বপ্নের জিনিস অথবা দরকারি যেকোনো কাজে টাকাটা কাজে লাগাব।
পোস্টার তৈরি
উদাহরণের ধাপগুলো অনুসরণ করে তোমার প্রয়োজনীয় কোনো কিছু কেনার জন্য একটি আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করো।
কীভাবে আর্থিক ডায়েরিতে হিসাব রাখতে হয় তা নিশ্চয়ই তোমরা সবাই শিখেছ। এর পাশাপাশি কীভাবে প্রয়োজন বুঝে খরচ করে টাকা জমাতে হয় তাও শিখেছ। কিছু কেনার জন্য কীভাবে আর্থিক পরিকল্পনা করতে হয়, তাও এখন সবাই জানো। তাহলে এবার চলো, আমরা একটি প্রজেক্ট হাতে নিই।
ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য সাধারণত যা যা লাগে, সেগুলো হলো-
- শিক্ষার্থী ও বাবা-মা কিংবা আইনগত অভিভাবক প্রত্যেকের ০২ কপি করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি
- জন্মনিবন্ধন সনদ বা স্কুল থেকে দেওয়া আইডি কার্ডের ফটোকপি কিংবা অন্য গ্রহণযোগ্য সার্টিফিকেট বাবা-মা কিংবা আইনগত অভিভাবকের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, কিংবা তাদের পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবে ছবিযুক্ত অন্য যেকোনো ডকুমেন্ট (চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট/প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্টের কপি, ড্রাইভিং লাইসেন্স এর কপি ইত্যাদি)
- হিসাব খুলে প্রাথমিকভাবে জমা দেওয়ার জন্য মাত্র ১০০ টাকা। তবে চাইলে বেশি টাকা জমা করেও হিসাব খোলা যাবে।
এবার এসো, আমরা একটি ব্যাংক হিসাব/অ্যাকাউন্ট এর নমুনা ফরমে সাধারণত কী কী থাকে তা জেনে নিই।
সঞ্চয় থেকে স্বপ্নপূরণ
ঊষা চাকমার ভীষণ ফুটবল প্রীতি। টিমে সে খুব ভালো খেলে। সে খাবার না খেয়ে একদিন কাটাতে পারে, কিন্তু ফুটবল না খেলে একদিনও থাকতে পারেনা। সে সপ্তাহে একদিন দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে দূরে শহরের খেলার মাঠে ফুটবল ক্লাবে খেলতে যায়। বাড়িতে খেলার জন্য তার কোনো ফুটবল নেই, নেই কোনো খেলার বুট কিংবা নীপ্যাড। খেলতে গিয়ে প্রায়ই ব্যথা পেয়ে বাড়ি ফিরে। ব্যথা নিয়েই সে রাত জেগে পড়ালেখা করে আবার সকালে উঠে স্কুলের পথে যাত্রা করে।
স্কুলও খুব কাছে নয়। সেই পাহাড়ের ওপর। ব্যথা নিয়ে এতটা পথ হেঁটে আসা-যাওয়া করা খুবই কষ্টকর। কিন্তু আঁকাবাঁকা এই পাহাড়ি পথে রিকশা, ভ্যানেরও চলাচল নেই। ওর বন্ধুদের দু-একজনের সাইকেল আছে। ওরা পালা করে একেক দিন একেকজনকে লিফট দেয়। একদিন উষা ওর বন্ধু রনির সঙ্গে সাইকেলে যেতে যেতে জানতে চাইল তার সাইকেল কেনার বৃত্তান্ত।
ওর গল্প শুনে ঊষা খুব অনুপ্রাণিত হলো এবং সে ঠিক করল রনির মতো আর্থিক ডায়েরি অনুসরণ করে অর্থ সঞ্চয় করবে এবং তার স্বপ্নের ফুটবল, বুট আর ফুটবল খেলার সামগ্রী কেনার জন্য একটি আর্থিক পরিকল্পনা শুরু করবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। ঊষা টাকা জমাতে লাগল ব্যাংকে। বছর না ঘুরতেই তার জমানো টাকায় সে কিনে ফেলল তার মনের খিদে মেটানোর সামগ্রীগুলো। ঊষার খুশি আর ধরে না।
কী যে আনন্দ লাগছে তার। নিজের সঞ্চয় দিয়ে স্বপ্নপূরণে এত সুখ! আমরাও পারি, ঊষার মতো নিজেদের স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলতে। তাই চলো সবাই-
ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জনাই আমার প্রয়োজন আমি সেটাই ।
স্বমূল্যায়ন
এই অধ্যায়ে আমরা যা যা করেছি টিক চিহ্ন দাও
আরও দেখুন :