দলনেতা হওয়ার ৭টি গুন এবং অবশ্যই পরিতাজ্য ৭টি দোষ | ক্যারিয়ার ম্যানেজমেন্ট | শামস্ বিশ্বাস : যে কোন দলগত সাফল্যের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি তা হল সুযোগ্য নেতৃত্ব। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট একটি মডেল কিংবা চিন্তাধারা থাকতেই হবে। সুযোগ্য নেতা হতে গেলে অবশ্যই তাঁকে দায়িত্বপরায়ণ এবং কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে। দলনেতা হতে গেলে কেবল কয়েকটি গুণ থাকাটাই যথেষ্ট নয়, যে কয়েকটি দোষ কিংবা ত্রুটি নিয়েও ভাবা দরকার। বলা ভালো, যেগুলো প্রথমেই নিজের চরিত্র থেকে বাদ দিতে হবে। ভালো গুণাবলী তাহলে নিজে থেকেই জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে।
দলনেতা হওয়ার ৭টি গুন এবং অবশ্যই পরিতাজ্য ৭টি দোষ
নেতার ‘সেভেন সি’ গুণাবলি হল: ‘বিশ্বাসযোগ্যতা (Credibility)’, ‘সহমর্মিতা(Empathy)’,‘দৃষ্টির স্বচ্ছতা ( Clarity of sight)’, ‘Friendship (সখ্যতা)’, ‘Liability (দায়বদ্ধতা)’, ‘Carisma (জনমোহিনী ক্ষমতা)’, এবং ‘Skill (দক্ষতা)’ – দলনেতার এই সাতটি আবশ্যিক গুণ নিয়ে এর আগেও অনেকে নানান আলোচনা করেছেন। আমি তাহলে নতুন কী কথা বলবো? আমি বলব সেই সাতটি দোষের কথা, নেতার আসনে বসার আগে যেগুলোকে বিসর্জন দেওয়াটাই কাম্য।
এ এক অদ্ভুত মডেল! যে সাতটি পাপস্খালনের কথা বলতে চলেছি, তা শুধু সুযোগ্য দলনেতা হওয়া নয় আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয়। এই সাতটি দোষ হল: লোভ, সর্বগ্রাসী কামনা,আলস্য, হিংসা, পদস্খাল, আত্মম্ভরিতা এবং ক্রোধ। নিশ্চয়ই এদের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে বসে গেছেন! আসুন একটু দেখে নেওয়া যাক।
লোভ ত্যাগ করুন:
সুযোগ্য দলোনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে প্রথমেই নিজেদের মধ্যে থেকে লোভ-কে চিরতরে দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের নেত্রীত্ব কালচারের এটাই সবচেয়ে প্রধান দোষ। দলোনেতা হওয়ার পরে নিজের দলের সবার জন্য নিবেদিত প্রাণ না হয়ে নিজের নাম থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্সের উন্নয়ন করা। এজন্য আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ছি! তাই আজ যেন ভীষণ জরুরি আমাদের দলনেতাদের ঈৎবফরনরষরঃু তথা বিশ্বাসযোগ্যতা।
একজন দলনেতার ব্যক্তিত্বের চরিত্র সবার প্রথমে এই গুণের দ্বারাই নিদ্ধারিত হয় জনমানে। আর একবার সেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে তলে তলে অনেক কিছু গুছিয়ে নিতে হয়ত পারবেন, কিন্তু নিজের যে সম্মানটুকু আপনি হারাবেন, তা ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারো নেই। বলাই বাহুল্য, এই বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাতেই সবচেয়ে পিছিয়ে আমাদের নেতৃবৃন্দ। বিশ্বাসযোগ্যতার এ এক মহাসংকট।
সর্বগ্রাসী কামনা ধ্বংশ করে:
লোভের পর আসছি গ্লুটোনি অর্থাৎ সর্বগ্রাসী কামনার কথায়। সবকিছু নিজের দখলে নিয়ে নেওয়ার এই মানসিকতাও বড় মারাত্মক সন্দেহ নেই। খাব-দাব, বিয়ে-শাদি করব, ঢাকায় নিজে ফ্লাট বাড়ী গাড়ী করবোÑ এটাই কি আসল লক্ষ্য মানব জীবনের লক্ষ? গব কিছুর লক্ষ তো হওয়া দরকার মানব কল্যাণ। তা না হলে তাহলে দিনের পর দিন যারা না খেতে পেয়ে দিন কাটাচ্ছে, তাদের কথা ভাববে কে? এমনকি বিশুদ্ধ খাবার পানীর ব্যবস্থা নেই তাদের জন্য।
এই হতভাগাদের কথা আমাদের সবাইকেই ভাবতেই হবে। কেবল নিজের আহার-বিহার-সংসার নিয়ে মেতে থাকার কোনও অধিকার আমাদের কারো নেই। বরং জীবনের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কীভাবে নিদেনপক্ষে অসহায় মানুষজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই চিন্তাই প্রধান হওয়া উচিত দলনেতার। নেতা হতে গেলে নিজের স্বার্থে বাঁচা নয়, প্রয়োজন প্রতিবেশির প্রতি ঈড়সঢ়ধংংরড়হ তথা সহানুভূতি। আশপাশে যারা মাথার উপর ছাদহীন অবস্থায় প্রায় অভুক্ত থেকে দিনাতিপাত করছেন,তাদের কথা একজন নেতা কখনই ভুলে থাকতে পারেন না। এই সহায়সম্ব^লহীন মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে লড়াই করাটাই আসল নেত্রীত্ব।
আলস্য নয়:
পরের দোষ আলস্য। এই আলস্য দূরে রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি। আলস্য অর্থে আমি মানসিকভাবে চরম উদাসীন এবং শারীরিকভাবে অকর্মণ্যতার কথা বলছি। সক্রিয়ভাবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের পথে হাঁটার বদলে আলিস্যিতেই দিন গুজরান ঠিক নয়। এই দশা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টির অত্যন্ত প্রয়োজন। কর্মক্ষম হওয়াটাও তাঁদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। সজাগ তাঁদের থাকতেই হবে। এটাকেই বলেছি ঈষধরৎাড়ুধহপব অর্থাৎ দৃষ্টির স্বচ্ছতা। দলের ভবিষ্যৎ আগে অনুধাবন করে সেই দিকে দল ও দলের সদস্যদের চালনা করাতেই সংগঠনের উন্নয়ন।
হিংসাপ্রবণতা:
চতুর্থ দোষ হিসেবে আমি হিংসাপ্রবণতার কথাই বলব। এই একটা কারণেই মানুষ দ্রুতগতিতে নিচে নেমে যেতে পারে।নিজের সহকর্মীদের প্রতি হিংসাপরায়ণ হওয়াটা কোনও দরনেতার কাছে কখনই কাম্য নয়। শুধু সহকর্মী নয়, বিরোধী, ভিন্নমতাবলম্বি ও সমালোচকদের প্রতিও হিংসা কোনওভাবেই সুখকর নয়। অন্তত দেশ ও সমাজেরর স্বার্থে তো নয়ই। হিংসা মানে তা কেবল হিংসাত্বক ঘটনার জন্ম দেয়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, পরস্পরকে সমর্থন করার চেয়ে টেনে নামিয়ে দেওয়াতেই যেন আমাদের নেত্রিত্বের আসল তৃপ্তি! তাই এক্ষেত্রে প্রয়োজন ঈধসধৎধফবৎরব অথাৎ সখ্যতা। এই সখ্যতা অবলম্ব^ন করেই আপনি পারেন গোটা দেশকে পুরো সমাজকে নিজের পাশে পেতে। এমনকি বিরোধীর-সমালোচকদের মুখ বন্ধ রাখতেও আপনাকে নিশ্চিতভাবেই খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।
পদস্খালন:
পঞ্চম যে দোষ এড়িয়ে চলতে হবে তা হল পদস্খাল। আসলে যে দোষের কথা আমি প্রকৃতপক্ষে বলতে চাইছি, অনেক সময়ে দেখা যায় ক্ষমতার দম্ভে দলনোতার পদস্খাল ঘটে মাদক থেকে শুরু করে নানা কেলেংকারীতে জড়িয়ে পরে। পরে কেলেংকারীটা ঢাকতে গিয়ে নিজ সংগঠন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। অনেক মেধাবি দলনেতা কেলেংকারী ফাঁদে পড়ে হারিয়ে গেছে। তাই এটা শুধুই পদস্খাল প্রশ্ন হিসাবে থাকছে না। এর পেছনে রয়েছে অন্যকে অপারাধে ইন্ধন দেওয়া ও নিজেও সরাসরি অপরাধে সামিল হওয়া। কাজেই কোনও নেতা যদি উন্নত জীবন চান তাহলে এই পদস্খাল তাকে দমন করতেই হবে।
আত্মম্ভরিতা:
দলনেতাদের ষষ্ঠ দোষ হল তাদের আত্মম্ভরিতা। এই দোষ অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। এটা তাদের অন্ধ করে দেয়। যা তাদের পরবর্তী ‘সি’তে পৌঁছতে দেয় না। তাদের মধ্যে জনমোহিনী ক্ষমতা থাকে, আর এর প্রভাবেই তারা নিজেকে অসীম ক্ষমতাধর ভাবতে শুরু করেন। আর এই কারণেই তাদের পতন ঘটে। এই আত্মম্ভরিতা তাদের ভাবায় তারাই সবকিছু। তারা তখন সংগঠনের সদস্যদের নিজেদের করায়ত্ত বলে ভাবতে থাকেন, ভাবেন তিনি যা বলবেন তাই শুনবে সদস্যরা। ফলে তারা সংগঠনের জনকল্যাণমূলক কাজও বন্ধ করে দেন। তারা তখন অহংকারে মত্ত হয়ে সংগঠনের সাধারণ সদস্যরা যা চায় তাও শোনেন না, উপেক্ষা করেন।
তোষামোদ:
যারা তখন কাছে থাকে তারাও হয়ে ওঠে তাঁরই মতে সায় দেওয়া তোষামুদের দল। তাই এই আত্মম্ভরিতাই শেষ পর্যন্ত দলনেতার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর যাদের এই দোষ স্পর্শ করে না তারাই শেষ অবধি টিকে থাকেন। তারা সাধারণ মানুষের কথা শোনেন, নিজের উঁচু মঞ্চ থেকে নেমে আসেন সাধারণের স্তরে। একমাত্র তাদেরই থাকে স্বাভাবিক ক্যারিশমা, এটাই পরবর্তী ‘সি’ ক্যারিশমা (জনমোহিনী শক্তি)। এই ক্যারিশমাই তাদের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ ধরে রাখে। এটাই তাদের জনপ্রিয়তা এনে দেয় ও ক্রম উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেখানে আত্মম্ভরিতা তাদের মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, নেতিবাচক প্রচার গড়ে দেয় এবং একদিন নিচে ফেলে দেয়। কাজেই দলনেতাদের আত্মম্ভরিতায় মদমত্ত না হয়ে প্রকৃত স্বাভাবিক ক্যারিশমার জনমোহিনীকে বিস্তার করতে হবে।
ক্রোধ:
এবার আমার এসে পৌঁছেছি শেষ দোষটিতে। এই দোষটি এতটাই মারাত্মক যে শুধু নেতার নয় সব মানুষদের মধ্যেই অল্পবিস্তর রয়েছে। কিন্তু দিনদিন দেখা যাচ্ছে এটা নেতাদের স্বভাবজাত মতো হয়ে উঠেছে, একে অবশ্যই পরিহার করতেই হবে। এই দোষ হল ক্রোধ। নেতাদের বুঝতে হবে ক্রোধ হল আর কিছু না শুধুই সময়ের অপচয়। এটা ক্ষতিকর। অন্যের উপরে রাগ দেখাতে গিয়ে নিজেরই ক্ষতি। এখানে দরকার শেষ ‘সি’কনিফিডেন্ট (আত্মবিশ্বাস)। নিজের উপর প্রবল আত্মবিশ্বাসই পারে অন্যের উপর ক্রোধের বশবর্তী হওয়া থেকে রক্ষা করতে।
নবীন দলনেতাদের প্রয়োজন এই ৭টি দোষকে ত্যাগ করে ৭টি গুণ অবলম্বন করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাও সে তুং, চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো, জর্জ ওয়াশিংটন, ভøাদিমিন লেনিন এদের প্রত্যেকের জীবন হল এই ৭টি দোষ পরিত্যাগ করে ৭টি গুণের সমাহার। এই ৭টি দোষকে ত্যাগ করে ৭টি গুণ অবলম্বন করা করতে পালতে আজকের তরুন আগামী দিনের সফল নেত্রীত্ব দিবে, সমগ্র বিশ্ববাসীকে শন্তি ও সমৃদ্ধির পথ দেখাবে।
আরও পড়ুন: