আবেগ, আবেগের প্রকারভেদ এবং আবেগের প্রভাব

আবেগ, আবেগের প্রকারভেদ এবং আবেগের প্রভাব আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বাউবি এসএসসি ২৩৫৮ ক্যারিয়ার শিক্ষা” এর  “ক্যারিয়ার গঠনের উপাদান ও কৌশল” ইউনিট ২ এর অন্তর্ভুক্ত।

 

আবেগ, আবেগের প্রকারভেদ এবং আবেগের প্রভাব

মানুষের জীবনের সাথে আবেগ ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। মানুষের আচরণের উপর আবেগের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর। মানুষ যুক্তিবাদী প্রাণী। তার আচরণ যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেচনা নির্ভর। তা সত্ত্বেও মানুষের অধিকাংশ আচরণ তার আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। মানুষকে ভালভাবে বুঝতে হলে তার আবেগকে বুঝতে হবে।

আবেগ কী, আবেগের প্রকৃতি, বিভিন্ন আবেগের কাজ, মানুষের আচরণে আবেগের প্রভাব ইত্যাদি না জানলে মানুষকে বোঝা সহজ হয় না। মানুষের আবেগিক বিকাশের উপর তার ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে। সুষ্ঠু জীবন যাপন করতে হলে আবেগের সঠিক বিকাশ ও প্রকাশের প্রয়োজন আছে। আবেগিক বিকাশ সুষ্ঠু না হলে আবেগিক আচরণও সুন্দর, সংযত ও সমাজসম্মত হয় না। আবেগিক বিকাশ সুষ্ঠু না হলে ব্যক্তির জীবনে অনেক আবেগিক সমস্যা ও অপসঙ্গতি দেখা যায়।

কাজ – এক

নিচের এ কাজটি কমপক্ষে ৭ দিন ধরে করতে থাকুন। সময় করে আপনার সন্তান বা আপনার ছোট ভাই বা বোন বা পরিবারের কোন ছোট সদস্যকে (যে স্কুলে পড়ে) তার লেখাপড়ার ব্যাপারে সাহায্য করতে বসুন। এক থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে তাকে পড়াতে থাকুন। আপনার শিক্ষার্থীর মনোযোগ, মনোযোগের অভাব, অস্থিরতা, ভুল উত্তর দেয়া বা সঠিক উত্তর দেয়া ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের ফলে আপনার আবেগতাড়িত আচরণ (ধৈর্যচ্যুতি বা ধৈর্যরক্ষা) কিরূপ হয় তা লক্ষ করুন এবং প্রতিটি আচরণের জন্য কোন ধরনের আবেগ কাজ করছে তা লিখুন ।

 

আবেগের প্রকারভেদ

 

আবেগ

কোন কোন উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দেয়ার ফলে আমাদের দেহমনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া ও আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এই প্রতিক্রিয়ার ফলে আমরা কান্না, হাসি, দুঃখ, রাগ ইত্যাদি বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা অনুভব করি এবং প্রকাশ করি। আবেগের সম্পর্ক মনের এই বিশেষ অবস্থার সাথে। আবেগ মনের একটি বিচলিত অবস্থা।

মনোবিজ্ঞানীরা আবেগের সংজ্ঞা দিতে নানা রকম মত পোষণ করেন। ক্ল্যাপারীড বলছেন, ”আবেগের মনস্তত্ত্ব মনোবিদ্যার এক জটিল বিষয়।” আবেগ আমাদের অনুভূতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিন্তু শারীরিক বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে আমরা আবেগ প্রকাশ করি। ইংরেজিতে আবেগকে emotion বলা হয়। ল্যাটিন শব্দ ইমোভার থেকে (emovere) emotion শব্দের উদ্ভব। এর অর্থ হল প্রক্ষুদ্ধ বা উত্তেজিত হওয়া। তাই বলা যায় আবেগ হল মনের সেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশমান অবস্থা যা ব্যক্তিকে দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে বিচলিত করে।

আবেগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উত্তেজিত হওয়া। যে কোন আবেগঘন পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা তার তিনটি দিক দেখতে পাই ।

১. বাহ্যিক আচরণ ২. অভ্যন্তরীণ আচরণ ৩. আবেগমূলক অনুভূতি বা সচেনতা ।

বাহ্যিক আচরণ: কোন আবেগের প্রভাবাধীন হলে প্রত্যেক প্রাণী কতগুলো বাহ্যিক আচরণ সম্পন্ন করে। যেমন, ভয় পেলে মানুষ পালায়, রাগ করলে হাত পা ছোঁড়ে বা আক্রমণ করে ইত্যাদি। এই আচরণগুলোর একটি সাধারণ লক্ষণ হল যে এগুলো সংহতিনাশক। অর্থাৎ প্রাণী যখন আবেগের বশবর্তী হয়ে কোন আচরণ করে তখন তার স্বাভাবিক অবস্থার সংহতি নষ্ট হয়ে যায়।

অভ্যন্তরীণ আচরণ: শরীরতত্ত্বের দিক থেকে আবেগ কতগুলো দৈহিক পরিবর্তনের সমষ্টি। এই দৈহিক পরিবর্তন নানা রকম হতে পারে, যেমন, রক্ত চলাচলঘটিত, গ্রন্থিঘটিত, স্নায়ুঘটিত, পেশীঘটিত ইত্যাদি।

আবেগমূলক অনুভূতি বা সচেতনতা: প্রাণীর মধ্যে আবেগ জাগলে সুখকর বা দুঃখকর যেমনই হোক একটি অনুভূতি থাকবেই। আবেগ অনুভূতিজাত। অনুভূতি যখন প্রবল হয়ে দৈহিক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয় তখনই সেটিকে আবেগ বলে।

আনন্দ, বিরক্তি ইত্যাদি দ্বারা আমরা যে উত্তেজিত বা বিচলিত অবস্থাকে বুঝি তাকে আবেগ বলি। আবেগের মানসিক দিক হল অনুভূতি। আর শারীরিক দিক হল নানারকম শারীরিক পরিবর্তন। দেখা যায় আবেগ হল শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার সংমিশ্রণ।

আবেগের প্রকারভেদ

আমাদের বয়স যত বাড়তে থাকে আবেগও তত জটিল হতে থাকে। আবেগমূলক যত আচরণ আছে সেগুলো অনেক সময় পৃথক করা হয় আবার অনেক সময় একত্রিত করে একাধিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে ম্যাগডুগালের মত অনেকটা বিজ্ঞানসম্মত। তিনি মানুষের আবেগকে তিন ভাগে ভাগ করেছেনঃ

১. প্রাথমিক বা মৌলিক আবেগ

২. জটিল আবেগ

৩. অর্জিত আবেগ

১. প্রাথমিক বা মৌলিক আবেগ: সহজাতভাবে যেসব আবেগ নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে তাকে মৌলিক আবেগ বলা হয় । ওয়াটসন এর মতে মানুষের মৌলিক আবেগ তিনটি। যথা: ভয়, ক্রোধ এবং ভালবাসা। সব প্রবৃত্তিরই একটি অনুভূতিমূলক দিক আছে। এই দিকই প্রবৃত্তিমূলক আচরণের রূপ ঠিক করে। ম্যাগডুগালের মতে প্রবৃত্তির মত মৌলিক আবেগও চৌদ্দটি। এই চৌদ্দটি আবেগ হল ভয়, ক্রোধ, বিরক্তি, স্নেহানুভূতি, কাম, বিষ্ময়, হীনমন্যতা, আত্মগৌরব, একাকীত্ববোধ, স্বাধীকারবোধ, সৃজনী স্পৃহা, আমোদ, ক্ষুধা ও দুস্থভাব। অনেক মৌলিক আবেগ জন্মের সময় থাকে না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় ।

২. জটিল আবেগ: অনেক সময় আমাদের দুটোর বেশি প্রবৃত্তি একসঙ্গে জাগে। ফলে প্রথমিক আবেগগুলো মিলেমিশে একটি মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি হয়। দুটো বা তার বেশি আবেগ একত্র হয়ে যে মিশ্র আবেগমূলক অবস্থা সৃষ্টি করে ম্যাগডুগাল তাকে মিশ্র বা জটিল আবেগ বলেছেন। যেমন, ম্যাগডুগালের মতে কৃতজ্ঞতা হল মমতা ও হীনমন্যতার মিশ্রণ, লজ্জা হল হীনমন্যতা ও আত্মগরিমার মিলিত রূপ, ঘৃণা হল ক্রোধ, বিরক্তি ও ভয়ের মিশ্রণ, প্রশংসা হল বিষ্ময় ও হীনমন্যতার মিশ্রণ ইত্যাদি।

৩. অর্জিত আবেগঃ প্রাথমিক ও জটিল আবেগ ছাড়া ম্যাগডুগাল অন্য আর এক ধরনের আবেগের কথা বলেছেন। সেটি হল অর্জিত আবেগ। বিবাদ, উল্লাস, আশা, আশঙ্কা ইত্যাদি হল অর্জিত আবেগ।

ম্যাগডুগালের এই শ্রেণিবিন্যাস বেশ সন্তোষজনক ও পূর্ণাঙ্গ। বর্তমানে এ শ্রেণিবিন্যাস অনেক জায়গায় অনুসরণ করা হয়ে থাকে। তবে এর সমালোচনাও আছে। জটিল আবেগ যে একাধিক আবেগের মিশ্রণ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সবক্ষেত্রে ম্যাগডুগালের বিশ্লেষণ গ্রহণযোগ্য না। পরিণত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সব আবেগই মিশ্রধর্মী।

 

নেতার গুণাবলি আবেগ, আবেগের প্রকারভেদ এবং আবেগের প্রভাব

 

আবেগের প্রভাব

যখন কোন ব্যক্তি আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয় তখন সে দেহমনে উত্তেজিত অবস্থায় থাকে। তার স্বাভাবিক সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। আবেগের সময় নানারকম অন্তদৈহিক পরিবর্তন দেখা যায়। প্রত্যেক আবেগের একটি নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি আছে।

আবেগের প্রভাবে দেহমনের যে পরিবর্তন ঘটে তাকে আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি। তারমধ্যে একটি হল বাহ্যিক আচরণের পরিবর্তন এবং অন্যটি হল দেহযন্ত্রের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন।

আচরণের বাহ্যিক পরিবর্তন

আমরা স্বাভাবিকভাবে যে সব আচরণ করে থাকি আবেগের সময় সেগুলোর অনেক পরিবর্তন হয়। সেগুলোকে আবেগকালীন আচরণ বলা যেতে পারে। সাধারণত আবেগের সময় বাহ্যিক আচরণের যে পরিবর্তন হয় সেগুলো হল:

  • মুখভঙ্গির পরিবর্তন: মুখকে মনের আয়না বলা হয়ে থাকে। মনের অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে মুখের ভাব ও ভঙ্গির পরিবর্তন হয়। বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে মানসিক অবস্থা মুখে প্রতিফলিত হয়। যেমন, অত্যাধিক ক্রোধে মুখের বর্ণেরও পরিবর্তন হয়।
  • অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবহারে পরিবর্তন: আবেগের সময় বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নাড়াচাড়া সাধারণ নিয়মে হয় না। রাগের সময় আমরা জোরে হাতপা নাড়াচাড়া করি। আবার যখন দুঃখ পাই তখন চুপ করে একা বসে থাকি ।
  • গলার স্বর বা কন্ঠের পরিবর্তন: বিভিন্ন আবেগে গলার স্বরে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন হয়। ভয়, আনন্দ, বিষ্ময় ইত্যাদি আবেগে বিভিন্ন রকম ধ্বনি হয়। কণ্ঠস্বরে ব্যক্তি বিস্মিত না আনন্দিত না দুঃখিত হয়েছে তা সাধারণভাবেই বোঝা যায়।
  • চোখের তারার পরিবর্তন: আবেগের সঙ্গে চোখের সম্পর্ক নিবিড়। আবেগের সাথে সাথে চোখের তারা কখনও বড় বা কখনও ছোট হয়। যেমন, বিস্ময়ে আমাদের চোখ বড় হয়ে যায়।

আচরণের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন

আবেগের সময় দেহযন্ত্রের অভ্যন্তরে অনেক পরিবর্তন হয়।

• হৃদযন্ত্রের স্পন্দনের পরিবর্তন: সুস্থ অবস্থায় মানুষের দেহে যে হৃদস্পন্দন মিনিটে ৮৪ বার হয়, বিশেষ আবেগের সময় তা বেড়ে মিনিটে ১০৪ বারে দাঁড়াতে পারে।

• হৃদস্পন্দন বাড়ার সাথে সাথে রক্তের চাপও বেড়ে যায়। আমরা দেখেছি অত্যাধিক ক্রোধে রক্তচাপ বেড়ে যায়।

• নাড়ীর গতির হারেও পরিবর্তন হয়। ভয়ে কারও কারও নাড়ীর গতি খুব দ্রুত হয় আবার অনেক সময় নাড়ীর বেগ কমে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

• রক্ত সঞ্চালনের পরিমাণ বৃদ্ধি, ত্বকের পরিবহন ক্ষমতার পার্থক্য, মস্তিষ্কের কাজের পার্থক্য, শ্বাসকার্যের পরিবর্তন ইত্যাদি আবেগের সময়ে উল্লেখযোগ্য দেহাভ্যন্তরীণ যান্ত্রিক পরিবর্তন। দেহের অভ্যন্তরে এসব পরিবর্তন সংঘটিত হয় স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তনের কারণে।

আবেগের প্রভাবে শারীরিক পরিবর্তন অপরিহার্য। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গেও পরিবর্তন ও দেহযন্ত্রের পরিবর্তন ব্যতীত আবেগ প্রকাশিত হতে পারে না।

 

Google news logo আবেগ, আবেগের প্রকারভেদ এবং আবেগের প্রভাব
আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন

 

কাজ – দুই

আপনার পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে দুজন ঘনিষ্ট ব্যক্তিকে (স্ত্রী বা পুরুষ) নির্বাচন করুন। বিভিন্ন সময় তাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করুন ও লিখুন। এ আবেগ তাদের আচরণকে কীভাবে প্রভাবিত করে বিস্তারিত লিখুন ।

সারসংক্ষেপ

আবেগের সময় দেহের ভিতরে বাইরে নানা রকমের পরিবর্তন হয়। আবেগের মাত্রার উপর প্রকাশের এই ভঙ্গি নির্ভর করে। মুখের ভঙ্গিতে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবহারে, কণ্ঠস্বরে, চোখের তারার পরিবর্তনে বাহ্যিক পরিবর্তন প্রকাশ পায়। হৃদস্পন্দন, নাড়ীর বেগ, রক্ত সঞ্চালন ইত্যাদির মাধ্যমে দেহের ভিতরের পরিবর্তন প্রকাশ পায়। শারীরিক পরিবর্তন আবেগের অপরিহার্য প্রভাব। মনোবিজ্ঞানীরা আবেগের বিভিন্ন শ্রেণীকরণ করেছেন। ওয়াটসন ভয়, রাগ, ভালবাসা এই তিনটি মৌলিক আবেগের কথা বলেছেন। ম্যাগডুগাল মৌলিক, জটিল ও অর্জিত এই তিনভাগে আবেহকে ভাগ করেছেন। এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শ্রেণীকরণ।

 

আরও পড়ুন….

Leave a Comment