ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বাউবি এসএসসি ২৩৫৮ ক্যারিয়ার শিক্ষা” এর “ক্যারিয়ার গঠনে সংযোগ স্থাপন ও আচরণ” ইউনিট ৩ এর অন্তর্ভুক্ত।
Table of Contents
ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা
মানুষ একা বেশিদূর পথ চলতে পারে না। সব কাজ একা করতে পারে না। কোন কোন কাজ করতে গেলে এক সময় তার অন্যের সাহায্যের দরকার হয়। জীবনের কোন না কোন জায়গায় তার সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। এভাবে দেখা যায় মানুষ সামজিক জীব। সে কারণে সে আত্মীয়, পরিজন ও বন্ধু নিয়ে জীবন যাপন করে।
এসব আত্মীয় বা বন্ধু জীবন পথে চলার জন্য তাকে নির্ভরতা দেয়, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তাই এমন বন্ধু দরকার যার উপর সে নির্ভর করতে পারে, যার উপর সে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। একজন ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন বন্ধুই এমন বন্ধু। এমন একজন বন্ধু পেলে জীবনে যত ঝড়ঝঞ্জাই আসুক না কেন বন্ধুর হাত ধরে পার হওয়া যায়। মানুষ সুখী হয়, আত্মশক্তিতে তার জীবন উদ্দীপ্ত হয়।
কাজ – এক
নিচের কাজটি করলে আপনি ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন মানুষকে চিনতে পারবেন এবং নিজে ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন কিনা যাচাই করতে পারবেন।
নিচের বাক্যগুলোর মধ্যে কোনগুলো ইতিবাচক চিন্তার জন্য প্রযোজ্য টিক (√) চিহ্ন দিন।
ইতিবাচক ভাবনা কী?
কোন বিষয় সম্পর্কে ভাল দিক চিন্তা করা হোল ইতিবাচক চিন্তা। এখানে ভাল বলতে যা গঠনমূলক তা বোঝানো হয়েছে। যেমন, আপনি আপনার অফিসে বা কাজের জায়গায় দেরী করে পৌঁছালে আপনার বড়কর্তা আপনাকে ডেকে বকাঝকা করেন অথবা আপনার কোন ক্ষতি হয়। নিঃসন্দেহে এতে আপনার মন খারাপ হয়। এর ফলে বড়কর্তার প্রতি আপনি যদি খারাপ ধারণা পোষণ করতে থাকেন, তাহলে আপনার মন সারাক্ষণই বিরূপ হয়ে থাকবে। কখনই শান্তি পাবেন না। দিনে দিনে বড়কর্তার সাথে সম্পর্ক খারাপ হবে। কিন্তু যদি ভাবেন এ আপনার জন্য ভাল হলো, ভবিষ্যতে কাজের জায়গায় যেতে আপনার আর দেরী হবে না।
এই ভাবনাটাই ইতিবাচক ভাবনা। যারা ইতিবাচক চিন্তা করে বা ভাবনা করে তারা প্রত্যেক কাজেই ভাল ফল আশা করে। কারণ তাদের মানসিক শক্তি হয় খুব জোরালো। ইতিবাচক মনের অধিকারী মানুষ সব সময় শরীর ও মনের দিক থেকে সুখী হয়; যে কোন পরিবেশে তারা মানিয়ে নিতে পারে। ইতিবাচক চিন্তার অনেক সুফল আছে। যেমন:
- প্রতিদিনের মানসিক বোঝা কমে যায়
- নিজের প্রতি বিশ্বাস জন্মে
- জীবন সুস্বাস্থ্যের ও দীর্ঘায়ু হয়
- অনেক বন্ধু পাওয়া যায়
- কোন বিষয়ে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
ইতিবাচক চিন্তা কীভাবে করা যায়?
একজন ভাল বন্ধু পেতে হলে নিজেকে সেভাবে গড়ে নিতে হয়। আপনি ভাল চিন্তা করুন আর না করুন, মনে রাখবেন এখন থেকে ভাল চিন্তা করতে শুরু করতে হবে। কোন কাজ শুরু করতে একটু সমস্যা হয়, চট করে হয় না। রাতারাতি কোন অভ্যাস গড়ে তোলা যায় না। তার জন্য অনুশীলন করা ভাল। আসুন দেখা যাক কীভাবে ভাল চিন্তা করতে শুরু করা যায়।
১. যখন কথা বলবেন তখন ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করবেন। প্রশ্ন হল ইতিবাচক শব্দ কী? আপনি যদি সব সময়ই নিজেকে বলেন যে আমি এটা পারবো না, তাহলে আপনার দ্বারা কোন দিনই কোন কাজ হবে না। বরং নিজেকে বলুন, হাঁ, এটা আমি পারবো। তাহলে দেখবেন কাজটি যত কঠিনই হোক না কেন আপনার তা গায়ে লাগবে না। এটাই ইতিবাচক শব্দ ।
২. মন থেকে খারাপ চিন্তাগুলো সরিয়ে দিয়ে ভাল চিন্তা করুন। যেমন, কোন মানুষ সম্পর্কে চিন্তা করার সময় তিনি যতই খারাপ মানুষ হন না কেন, তার ভাল দিক নিয়ে চিন্তা করুন। বলুন, লোকটার এই ভাল গুণটি আছে।
৩. যা ভিতর থেকে আপনাকে আত্মশক্তি দেয় এমন কথা বলুন। যে বিষয়টি আপনাকে আনন্দ দেবে, আপনাকে খুশি করতে পারবে সে বিষয় নিয়ে ভাবুন। যেমন, পরীক্ষায় পাশ করলে আপনার আনন্দ হবে, তাইনা? তাহলে বলুন, আমি অবশ্যই ভালভাবে পাশ করব। তাতে দেখবেন ভালভাবে পাশ করার জন্য আপনি পরিশ্রম করতে পারেন এবং আপনার কষ্ট হবে না ।
৪. নিজেকে বার বার ইতিবাচক ভাবনায় ধরে রাখুন। যেমন বলুন, একজন সুখী মানুষ হওয়ার সব কিছুই আমার আছে, আমি সুখী হবই।
৫. কোথাও কোন ভুল হলে বা খারাপ কিছু হয়ে গেলে, নিজেকে ক্ষমা করে দিন। মানুষ সব সময় সঠিক কাজটি করতে পারে না। অনেক সময় ভুল বা অন্যায় হয়ে যেতে পারে, তার জন্য নিজেকে দোষারোপ করবেন না। বরং কী জন্য এমন ভুল হল তা ভাবুন। কারণ আপনি ভুলটি করতে চাননি।
মনে রাখবেন, আজকে আপনার ভাল যা কিছু আছে, অতীতে তা ভেবেছিলেন বলেই পেয়েছেন এবং আজকে ভাল যাকিছু ভাববেন ভবিষ্যতে তা আপনার থাকবে ।
এবার আসুন আমরা একটি গল্প পড়ি-
তরুন নতুন একটি চাকরির জন্য দরখাস্ত করল কিন্তু সে বিশ্বাস করে না যে সে চাকরিটি পাবে। কারণ তার আত্মবিশ্বাস ছিল খুবই কম। সে সব সময় মনে করতো তার দ্বারা কিছু হবে না। নিজের প্রতি তার নেতিবাচক মনোভাব ছিল এবং সে জন্য সে ভাবতো যে তার সাথে অন্য যারা দরখাস্ত করেছে তাদের সবার তার থেকে অনেক বেশি যোগ্যতা আছে এবং তারা অনেক বেশি বুদ্ধিমান । চাকরির সাক্ষাৎকারের দিন যত বেশি এগিয়ে আসতে লাগল তরুন তত বেশি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। সাক্ষাৎকারের কথা যতই সে ভাবতো ভয়ে তার হাত পা কাঁপতো, বার বার সে ঘেমে উঠতো, রাতে ভাল করে ঘুম হতো না ।
সাক্ষাৎকারের নির্ধারিত দিনে সে দেরী করে ঘুম থেকে উঠল এবং সে দেখল যে সে যে শার্টটি পরে যাবে বলে ঠিক করেছে সেটি ময়লা হয়ে আছে। অন্য একটি শার্ট পরিষ্কার ছিল কিন্তু সেটি ইস্ত্রি করা নেই। অথচ শার্ট ইস্ত্রি করার মতো সময়ও তার হাতে নেই। কী আর করা? সে ঐ কোঁচকানো শার্টটি পরেই সাক্ষাৎকারের জন্য রওয়ানা দিল। ঘর থেকে বেরুবার সময় সে কিছুই খেল না; কারণ এমনিতেই তার অনেক দেরী হয়ে গেছে। যথাসময় সাক্ষাৎকার শুরু হল। তরুন এমনিতে ছিল ক্ষুধার্ত, তারপর তার কোচকানো শার্টটি নিয়ে যথেষ্ট ভয় ছিল।
সব মিলিয়ে সাক্ষাৎকারের টেবিলে সে সব প্রশ্নের উত্তর গুলিয়ে ফেলল। অর্থাৎ তার সাক্ষাৎকার ভাল হল না এবং চাকরিটি সে পেল না । একই পদের জন্য সেলিমও দরখান্ত করেছিল। কিন্তু সেলিমের মানসিকতা ছিল ভিন্ন। সে ভাবত চাকরিটি সে পাবে এবং পাওয়ার জন্য যা করার দরকার তা সে করত। অর্থাৎ সাক্ষাৎকারের জন্য সে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিত । সাক্ষাৎকারের আগের দিন সন্ধ্যায় সে তার জামা-কাপড়, জুতো, কাগজপত্র, কলম ইত্যাদি ঠিকঠাক করল এবং অন্যদিনের তুলনায় একটু আগে ঘুমাতে গেল।
সাক্ষাৎকারের দিন সে ভোরে ঘুম থেকে উঠল এবং হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকায় সে বোর্ডে উপস্থিত হওয়ার জন্য ধীরেসুস্থে নিজেকে তৈরি করল। সাক্ষাৎকারের টেবিলে কর্মকর্তাদের মাঝে সে চমৎকার একটি পরিবেশ তৈরি করল যাতে তারা সকলে সেলিমের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন। সুতরাং সেলিম চাকরিটি পেল। উপরের গল্প দুটি থেকে আমরা কী জানতে পেরেছি? এর ভিতরে কি কোন ম্যাজিক ছিল? নিশ্চয়ই না? সব কিছু খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছিল। এ থেকে আমরা এটাই জানতে পারি যে, ইতিবাচক মনোভাব মানুষকে প্রশান্ত ও সুখময় অনভূতি দেয়।
তার চোখের সামনে পৃথিবীটা আলোময় হয়ে ওঠে, সে আত্মশক্তি অনুভব করে। ফলে তার হাঁটাচলা, কথাবার্তা, অভিব্যক্তি সব কিছুতেই আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে। মানুষ দেহমনে সুস্থ থাকে এবং সব কাজেই সে প্রত্যাশিত ফল লাভ করে। এটাই ইতিবাচক চিন্তার শক্তি। একজন ইতিবাচক মানুষ হিসেবে যদি আপনি নিজেকে গড়ে তুলতে পারেন তবেই একজন ভাল বন্ধু অর্থাৎ ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন বন্ধু পাওয়ার আশা করতে পারেন ।
আসুন দেখি কীভাবে ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যায় –
- প্রথমে এটি নিশ্চিত করুন যে, আপনি নিজে একজন ইতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন মানুষ ।
- যার সাথে আপনি বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে চাচ্ছেন তার অভ্যাস, আগ্রহ এবং সে যে কাজগুলো করে সেগুলোর দিকে লক্ষ করুন এবং নিজের মধ্যে সেগুলো গড়ে তুলুন।
- দৈনন্দিন সামাজিক ক্ষেত্র যেমন, বাজার, মসজিদ বা মন্দির ইত্যাদিতে প্রতিদিন যাদের সাথে দেখা হয় তাদের সাথে ভাবের আদান প্রদান করে দেখুন আপনার রুচির সাথে মেলে কিনা, যদি মেলে তবে তার সাথে বেশি করে মেলামেশা করুন।
- সামাজিক অনুষ্ঠান বা মিলনকেন্দ্র যেমন, মসজিদ, পার্ক বা খেলার মাঠ ইত্যাদিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করুন।
- বন্ধুর সাথে যথেষ্ট সময় নিয়ে কথা বলুন, তাদের সাথে নিয়মিত দেখা করুন। যেন সে বুঝতে পারে যে আপনি তার কথা ভাবেন, তার প্রতি আপনার আগ্রহ আছে।
- বন্ধুর সমস্যার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং সমাধানের জন্য আগ্রহী হন।
- দৈনন্দিন সামাজিক ক্ষেত্র যেমন, বাজার, মসজিদ বা মন্দির ইত্যাদিতে প্রতিদিন যাদের সাথে দেখা হয় তাদের সাথে সাম্প্রতিক বিষয় যেমন, বাজার দর, আবহাওয়া ইত্যাদি নিয়ে মতামত বিনিময় করুন।
- বন্ধুর কাজের সাথে নিজের কাজ মিলিয়ে দেখুন কোথায় মিল পাওয়া যায়, সেখানে কাজ ভাগ করে নিন ।
- আপনার এলাকা/জেলা/থানা থেকে যে দৈনিক বা সাপ্তাহিক কাগজ বের হয় তা নিয়মিত পড়ুন এবং বন্ধুর সাথে তার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন।
- যে বিষয় নিয়ে আপনারা একমত সে বিষয় নিয়ে কথা বলুন।
কাজ – দুই
এই কাজে আপনাকে এমন একজন মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে যিনি আপনার পার্শ্ববর্তী কোন ব্যক্তি। তিনি আপনার সহপাঠী বা সহকর্মী বা প্রতিবেশী বা আত্মীয় হতে পারেন। যাকে আপনি পছন্দ করেন। তার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে আপনি আগ্রহী। তার ভাল দিক বা গুণগুলো লিখুন। সেইসব গুণ লিখুন যা আপনার ভাল লাগে। এবার আপনার নিজের দিকে লক্ষ করুন। আপনার ভিতর সেইসব গুণগুলো খুঁজে বের করুন এবং লিখুন যে গুণগুলো অন্যেরা প্রশংসা করে। এবার দুজনের গুণগুলো নিয়ে মেলান। যেগুলো মিলে যায় সেগুলোকে পৃথক করুন এবং আপনার পছন্দের মানুষকে দেখান ।

সারসংক্ষেপ
ইতিবাচক চিন্তাসম্পন্ন মানুষ নিজেকে এমনভাবে তৈরি করেন যে অন্য সব মানুষই তাকে পছন্দ করেন, তার প্রশংসা করেন। ফলে তিনি সহজেই বন্ধুলাভ করেন। কিন্তু জীবনের পথটিকে সহজ করতে তিনি ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। এ রকম বন্ধুই বিপদে তাকে আলো দেখায়, তাকে সুখী করে তোলে। বন্ধুত্বের এই সম্পর্কে তারা একে অপরের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারেন। ফলে জীবন অনেক সহজ ও সুন্দর হয়।
আরও পড়ুন….