কুমার বাংলাদেশের পেশাজীবী

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কুমার বাংলাদেশের পেশা।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।

কুমার বাংলাদেশের পেশাজীবী

গ্রাম বাংলার কুমারগণ কুম্ভকার/কুমার/পাল/কুলাল প্রভৃতি নামে পরিচিত। মৃৎশিল্প মানব জাতির একটি প্রাচীনতম শিল্প। বাংলাদেশে মাটির আসবাবপত্রের ব্যবহার ব্যাপক ও প্রাচীন। মাটির তৈরি শিল্পকর্ম ঘরের শোভা বৃদ্ধি করে থাকে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক পলিমাটির দেশ। মাটির আসবাবপত্র তৈরির জন্য উপযোগী আঠালো মাটি বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে মাটির আসবাবপত্রের ব্যবহার ব্যাপক । এদেশের মৃৎশিল্পীরা মাটির পুতুল, দেব-দেবীর মূর্তি, বিভিন্ন জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি, মাটির হাড়ি, সরার উপর নকশা ইত্যাদি তৈরিতে দক্ষতার ছাপ রেখে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা আদিম কাল থেকেই মানুষ প্রথম তৈরি করেছে তার তৃষ্ণার জলাধার—মাটির কলস বা কুণ্ড। সম্ভবত মধ্য প্রাচ্যেই সর্বপ্রথম মাটির পাত্র তৈরি করা হয়।

 

কুমার বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

বাংলাদেশের গ্রামে মাটির দেয়াল ঘেরা শনের বা টিনের ঘরের প্রচুর প্রচলন রয়েছে। লোকায়ত জীবনে গৃহস্থলীর তৈজসপত্র বলতে মাটির পাত্রই বোঝায়। মাটির তৈরি পানির কলস, সরা, জলপাত্র, জলকান্দা, মাটির হাড়ি, পাতিল, কড়াই, শানকি, মুড়িভাজার ঝাঁজর, বিভিন্ন প্রকার ঘটি, তরকারির পেয়ালা, থালা, বাসন, গামলা, বদনা, লবণের বাটি, পিঠা তৈরির পাত্র, পানের ডাবর, সুপারি রাখার মটকা, দই রাখার পাত্র, তামাক সেবনের কলিকা, হুকা,

ধূপদানি, ফুলদানি, ছাইদনি, মাটির প্রদীপ, পিদিম, কুপি, ফুলের টব, ধান, চাল রাখার মটকা, জালা ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাটির আসবাবপত্র। এছাড়া রয়েছে নানাবিধ মাটির পুতুল, দেব-দেবীর মূর্তি, জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি।

বাংলাদেশের মৃৎশিল্প একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এঁরা হচ্ছে কুমার বা কুম্ভকার। এঁদের উপাধি পাল। আর্যদের সমাজ প্রথায় এরা নিম্ন জাতের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। বাংলার স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমূহে কুমারের তৈরি মৃৎশিল্প ছিল সবার কাছে আদৃত।

কুমারদের উৎপত্তি সম্পর্কে একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। শিব-পার্বতীর বিয়ে উপলক্ষে প্রয়োজন হয়েছিল দু’টি কুণ্ড। তখন শিব তার রুদ্রাক্ষ থালা থেকে দু’টি রুদ্রাক্ষ ছিড়ে একটি পুরুষ এবং একটি নারী বানালেন। এই নারী পুরুষই বিয়ের কুণ্ডু তৈরি করে ছিল। আর এই নারী ও পুরুষ থেকেই কুম্ভকার সম্প্রদায়ের উৎপত্তি। সে জন্যই বাঙালি কুমারদের উপাস্য দেবতা ‘শিব’।

বৈশাখ মাসে কুমাররা চাকার উপর শিবমূর্তি বসিয়ে রাখে। বৈশাখ মাসে কুমাররা কাজ করে না। বাংলাদেশের কুমার পাড়াগুলি গড়ে উঠেছিল নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কুমারখালী, কুমারটুলী, কুমার ভাঙ্গা, কুমারগাঁও ইত্যাদি স্থানের নাম মৃৎশিল্পী সম্প্রদায়ের পরিচয় বহন করে আসছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী উনিশটি জেলায় ছয়শ আশিটি মৃৎপল্লী আছে।

বাংলাদেশের বৃহত্তম মৃৎশিল্প অঞ্চল হচ্ছে যশোর। যশোরের কুড়িটি থানায় একশ চৌত্রিশটি মৃৎপল্লী আছে। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফরিদপুর, বগুড়া জেলায় অনেক মৃৎপল্লী রয়েছে। মৃৎশিল্প একটি পারিবারিক শিল্প। পরিবারের নারী-পুরুষ এমনকি শিশুরাও একাজে ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশের কুমাররা সেই সনাতনী পদ্ধতিতে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মৃৎশিল্পের কাজকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। ১. মাটি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, ২. মাটিকে উপকরণ তৈরির উপযোগী করা, ৩. পাত্রের আকৃতি করা, ৪. রোদে শুকানো ও ৫. আগুনে পোড়ান। এ সমস্ত কাজ নারী-পুরুষ উভয় মিলেই করে থাকে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মাটি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং চাকের সাহায্যে কাজ ও পোড়ানো ইত্যাদি কাজগুলো করে পুরুষেরা। মহিলারা মূলত হাতে বা ছাচের সাহায্যে নানাবিধ পুতুল ও খেলনা তৈরি করে। পুরুষেরা কোনো পাত্রের মুখ থেকে শুরু করে পেট ও নিচের অংশ শেষ করে চাকের সাহায্যে। মহিলারা পাত্রের নিচের অংশ থেকে শুরু করে ক্রমাগত উপরের অংশে এসে শেষ করে এবং এটা ছাচের সাহায্যে পিটিয়ে করা হয়।

কুমাররা মাটি সংগ্রহের জন্য কোদাল, খন্তা, শাবল ব্যবহার করে। মাটি সংগ্রহ করে মাটি ‘খোলায়’ রাখা হয়। চার/ছয় মাস মাটি সংরক্ষণ করা হয়। এটাকে ‘জাগ” বলা হয়। তারপর মাটিকে ‘পা’ দিয়ে মাড়িয়ে নরম করা হয়। একে ‘ছেনা’ বলা হয়। এরপর পাত্র তৈরির সমপরিমাণ মাটি গোল করে ‘বুটি তৈরি করা হয়। অতপর মাটি পাত্র তৈরির জন্য প্রস্তুত হয়।

এই মাটি চাকের উপর বসিয়ে পাত্র তৈরি করা হয়। চাক দেড় থেকে দুই হাত ব্যাসার্ধের একটি গোলাকার চাকা। বাঁশ কেটে তিনটি রিং করা হয় এবং রিং তিনটি একসাথে যুক্ত করা হয়। নারকেলের ছোবড়া, চুন, আঁশ ও চুন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে বাঁশের চাকাকে প্রলেপ দেয়া হয়। এবং প্রায় ত্রিশ দিন রোদে শুকানো হয়। কুমার লাঠির সাহায্যে চাকা ঘোরায়।

কুমারের হাত সবসময় পিচ্ছিল রাখার জন্য একটি পাত্রে কাদামাটি মিশ্রিত পানি থাকে এবং একটুকরা সুতা থাকে যাতে তৈরি পাত্র আকার মত হলে সহজেই কেটে আলাদা করা যায়। কুমাররা প্রথমে পাত্রের আকার অনুযায়ী ছাঁচ তৈরি করে নেয়। ছাঁচের নাম আতলা। অতপর ‘চর’ ‘পারা’ ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ পাত্র তৈরি হয়। পাত্রগুলো তৈরির পর রোদে শুকানো হয়।

তারপর খয়ের, কাপড় কাচার সোডা এবং লাল মাটি একত্রে মিশিয়ে রং তৈরি করা হয়। এবং ন্যাকড়ার সাহায্যে পাত্রে রং করা হয়। আবার রোদে শুকানো হয় এবং আগুনে পোড়ান হয়। তৈরি দ্রব্যাদি সারি সারি তাকে সাজিয়ে তার ওপর দিয়ে মাটির প্রলেপ দেয়া হয়। তারপর আগুন দেয়া হয়। চুলায় আগুন দেয়ার আগে কুমাররা কিছু অনুষ্ঠান পালন করে।

 

কুমার বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

কুমাররা তাদের তৈরি জিনিসপত্র বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করে। আবার হাট-বাজারের নির্দিষ্ট স্থানে খোলা আকাশের নিচে বসে তাদের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে থাকে। শহরের কোনো কোনো বাজারে হাড়ি পাতিলের দোকান আছে। কুমাররা ইদানীং মাটি দিয়ে তৈজসপত্র বানানো শুরু করেছে। তারা মাটির হাতি, ঘোড়া, গরু, পাখি, ফুলদানী, টব, হরেক রকমের জিনিস তৈরি করছে।

তৈরি করছে মাটির তাল, বেল, কলা, কাঁঠাল, আম ইত্যাদি ফলফলাদি। এগুলোকে রঙ্গিন করে বিক্রি করে। বর্তমানে এগুলো ঘরের শোভাবর্ধনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পুঁজি, উপকরণ ও উৎপাদিত সামগ্রীর চাহিদা হ্রাসের কারণে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প অনেকাংশে বিলুপ্তির পথে। জীবিকার তাগিদে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের অনেকে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে।

সহযোগিতা পেলে এ পেশাকে ও ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে যুগোপযোগী করে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। মৃৎশিল্পদের তৈরি মাটির দেবদেবীর এখনও বেশ কদর আছে। মৃৎশিল্পীদের চড়ামূল্যে কাঠ কিনে/ঝোপ জঙ্গল থেকে পুতা কুড়িয়ে/ধানের খর জোগাড় করে নির্মিত দ্রব্যাদি পোড়াতে হয়। কুমাররা বিকিকিনির জন্য গ্রামবাংলার বিভিন্ন জেলায় মৃৎশিল্পের দ্রব্যাদির পসরা সাজিয়ে বসে।

কুমারদের গৃহস্থালীর দ্রব্যাদি নির্মাণ সম্পর্কে কবি মুকুন্দরাম একটা বর্ণনা দিয়েছেন— কাষ্ট আনি ভার বোঝা নানা চিত্রে ইট কাটে কুমার পোড়ায় পাঁজা নানা ইঁট করয় নির্মাণ দেউল হুজুদুরা মটে সৌধময় কৈল পুরীখান সুরম্য দীঘিতট তাহাতে বিচিত্র মট প্রতিমাটি করিল নির্মাণ

মধ্যযুগে ইট পোড়ানর কাজ কুমাররাই করতো। কুমার বংশের নারী-পুরুষ-কিশোর সবাই একাজের সাথে জড়িত।

১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশ ছেষট্টি মৃৎশিল্পী পল্লীতে আঠারো হাজারের মতো পরিবারের আনুমানিক ছিয়াত্তর হাজারের অধিক শিল্পী কর্মরত আছেন। সমাজ পরিবর্তনের ধারায় কুমারদের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। কুমারদের বাজার সীমিত হয়ে আসছে।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment