আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় গাছি বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।
গাছি বাংলাদেশের পেশাজীবী
খেজুর গাছ অবলম্বন করেই গাছী/শিউলী সম্প্রদায়ের উদ্ভব। সবুজের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সমস্ত এলাকায় রয়েছে নানা ধরনের গাছপালা। জানা যায় প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় প্রচুর খেজুর গাছ জন্মাতো।
বাংলাদেশে সাধারণত জংলী জাতের খেজুর গাছ জন্মে। খেজুর গাছ জন্মাতে বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশের যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, খুলনা জেলায় প্রচুর খেজুর গাছ দেখা যায়। বিশেষ করে যশোরের খেজুরের রস এবং খেজুরের পাটালি ও গুড় অনেকের কাছে লোভনীয় বস্তু। যশোরের খেজুরের রসের নলেন গুঁড়, ঝোল গুঁড়, দানা গুঁড় ও নলেন পাটালীর স্বাদই আলাদা।
প্রবাদ আছে যশোরের যশ খেজুরের রস যারা খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে তারাই গাছী। গাছী খেজুর গাছের মাথার একপাশের ডাল কেটে ফেলে। তারপর ধারাল ছেনি দিয়ে কয়েক বার সেখানে ‘চাচা দেয়। দুই তিন দিন অন্তর অন্তর ‘চাচ’ দিতে দিতে এক সময় রস বের হতে থাকে। গাছী চাচ দেয়া অংশের দু’দিকে বাঁশে চিকন ‘গজাল’ পুতে দেয়। চাচ দেয়া অংশের মাঝখানে কেটে একটা নালির সৃষ্টি করে।
নালির মাথায় বাঁশের চিকন ‘নল’ গেড়ে দেয়। এরপর মাটির পাতিল দড়ি দিয়ে বেঁধে সন্ধ্যায় গাজালের সাথে ঝুলিয়ে রেখে আসে। সারা রাত পাতিলে রস পড়তে থাকে। গাছী সকালে রস সংগ্রহ করে। গাছী শীত মৌসুমে গাছ কাটে। সারা শীত মৌসুম ধরেই রস পাওয়া যায়। রস থেকে পাটালি, গুড় তৈরি করে। গাছী, ছেনি, দড়া, বাঁশের গজাল, আকড়া, ডুলা, বাঁশের নল ইত্যাদি ব্যবহার করে।
হিন্দুদের একটি বিশেষ সম্প্রদায় শিউলী। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে খেজুর গাছ কেটে রস এবং সেই রস দিয়ে যারা গুড় উৎপাদন করত তারাই শিউলী নামে পরিচিত। এরা গাছী নামেও পরিচিত। মুকুন্দরামের লিখনীতে শিউলী/গাছী শ্রেণীর পরিচিতি পাওয়া যায়। শিউলি নিবসে পুরে খাজুর কাটিআ ফিরে গুড় করে বিবিধ বিধানে।
ওয়েস্টল্যান্ড–এর ভ্রমণ বর্ণনা থেকে যশোরে প্রচুর খেজুর গাছের চাষের কথা জানা যায়। তার বর্ণনায় পাওয়া যায় যশোরে খেজুরের রস থেকে চিনি তৈরি হতো। ১৮৭১ সালে যশোর জেলায় মোট ১,০০,০০০ মণ খেজুরের রস নিঃসৃত চিনি উৎপন্ন হতো বলে জানা যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কোটচাদপুর, ত্রিমোহনী, ঝিকরগাছা, নারিকেল বাড়ী, চালগাজী ও তাহেরপুর প্রভৃতি স্থানে ইংরেজ কুঠিতে গাছীদের কাটা খেজুর গাছের রস থেকে চিনি উৎপন্ন হতো। খেজুর চাষী বা গাছী রস জ্বাল দিয়ে তা ব্যাপারী বা পাইকারদের কাছে বিক্রি করতো। গাছীরা নিজের গাছ কাটে একই সাথে গ্রামের অন্যান্য খেজুর গাছও তারা বর্গাচাষীর পদ্ধতিতে কেটে থাকে।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খেজুর রস ও গুড়ের উৎপাদন শুরু করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ সুস্বাদু ও সুমিষ্ট গুড়ের বাদামী চিনির স্বাদ নতুন করে গ্রহণ করতে পারবে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটানোর পরও রফতানি করে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ মডেল হতে পারে। তাতে বাংলাদেশের গর্বের স্থান আরো উঁচু করে রাখতে সক্ষম হবে খেজুর গুড় শিল্প।
এক সময় ছিল এই শিল্পের রমরমা অবস্থা। ১৮৬১ সালের দিকে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই খেজুর গুড় থেকে ‘ব্রাউন সুগার’ অর্থাৎ বাদামী চিনি উৎপাদিত হত। ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউজ ও এমেট এন্ড চেম্বার কোম্পানি যশোরের ঐতিহ্যবাহী কপোতাক্ষ নদের তীরে চৌগাছার তাহেরপুরে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ব্রাউন সুগার উৎপাদন করে বিশাল খ্যাতি অর্জন করেছিল।
বাংলাদেশে এখনো নতুন করে গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর গুড় শিল্পের প্রসার ঘটানো সম্ভব। বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী পরিবেশবিদ, গবেষক, অর্থনীতি বিশারদ ও সংশ্লিষ্ট অনেকেই বিশাল সম্ভাবনাময় শিল্পটির ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
খেজুর গুড় শিল্পে তেমন পুঁজির প্রয়োজন হবে না। অযত্ন ও অবহেলায় বেড়ে উঠা মধুবৃক্ষ আবাদে কোনো খরচ নেই। বাড়তি পরিচর্যার জন্য সময় ব্যয় করতে হয় না। বিনা পুঁজির শিল্পটি খুব সহজেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম। অথচ এই দিকটিতে কখনো কেউ নজর দেয় না। চিনি তৈরির জন্য আখ আবাদ ও মাড়াইসহ যে বিরাট খরচ করতে হয়, খেজুর গুড়ের চিনি তৈরিতে তার সামান্যও খরচ হবে না।
এজন্য প্রতিটি মৌসুমে বেশি সংখ্যক মধুবৃক্ষ জন্মানো এলাকার গ্রামে গ্রামে রস ক্রয় কেন্দ্র খুলতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে স্থাপন করতে হবে অত্যাধুনিক কারখানা। সেখানে রস জ্বালানো, গুড় ও পাটালি তৈরি এবং বাদামী চিনি তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বিশাল জনগোষ্ঠী আর্থিকভাবে লাভবান হবে। মানুষ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, খেজুর গুড় থেকে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চিনি উৎপাদনের একটা উদ্যোগ আসলে নেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে সার্বিক পরিবেশ দেশে বিদ্যমান। পদ্মার এপারে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এর জন্য সবচেয়ে উপযোগী। তা ছাড়া ফরিদপুরসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও প্রচুর খেজুর গাছ জন্মে।
কয়েকটি এলাকা বিশেষ করে যেসব এলাকায় আপনা-আপনিই খেজুর গাছ উৎপন্ন হয় বেশি সেসব এলাকায় প্রাথমিক পরীক্ষামূলকভাবে সরকার খেজুর গুড় শিল্প হিসেবে স্থাপনের উদ্যোগ নিতে পারে। খেজুর গাছ কিংবা মধুবৃক্ষকে ঘিরে যশোরে খাজুরা গ্রাম, মধুগ্রাম ও মধুপুর গ্রাম নামকরণও হয়েছে এক সময়। এই অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে বর্তমানে খেজুরের রস, গুড়, নলেন পাটালি তৈরি এবং রসের পিঠাপুলি আর পায়েস খাওয়ার ধুম পড়েছে।
নতুন ধানের চাল ও আটা আর নতুন খেজুরের রস ও গুড়ের সুবাসে গ্রামবাংলা আমোদিত হচ্ছে এখন। সত্যিই মধুবৃক্ষের রসে গ্রামীণ পরিবেশ বড়ই মধুর হয়ে উঠেছে। মধুবৃক্ষ থেকে রস সংগ্রহ ও রস জ্বালিয়ে গুড় পাটালি তৈরিতে কোনো নতুনত্ব আসেনি কোথাও। স্থানীয় প্রাথমিক জ্ঞাননির্ভর প্রযুক্তিতে রস সংগ্রহ ও গুড় পাটালি তৈরি হচ্ছে।
শুধুমাত্র যশোরের খাজুরা এলাকার কয়েকটি স্থানে নলেন পাটালি তৈরি হয়। তাও আগের মতো উন্নতমানের ও স্বাদের নয়। কোনো পরিকল্পনামাফিক কিছুই হয় না। শীত মৌসুম এলে গাছিরা প্রথমে মধুবৃক্ষের ডালপালা পরিষ্কার করে। তারপর ধালো গাছি দা দিয়ে কয়েকদিন থেমে থেমে ‘ছোল’ বা ‘ভুতি’ টানা হয়। পরে দেয়া হয় ‘চাচ’। তাতে বাঁশের নলি বসিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হয় মাটির ভাঁড়। ওই নল দিয়ে টপ টপ করে রস পড়ে ভর্তি হয় ভাঁড়।
বিকালে বেঁধে দেয়া হয় ভাঁড় নামানো হয় ভোরে। তারপর বাড়ীর বড় চুলায় বড় টিনের পাত্রে রস জ্বালানো হয়। প্রথমে গুড় ও গুড় থেকে পাটালি তৈরি হয়। একই পদ্ধতিতে রস ও গুড়ের উৎপাদন চলছে বছরের পর বছর ধরে। কোনো নতুনত্ব নেই। অথচ পদ্ধতির পরিবর্তনের যথেষ্ট সুযোগ আছে। কখনও কোনো গাছিকে কেউ পরামর্শ দেয় না এ ব্যাপারে।
যার জন্য খেজুর গাছের কদরও গ্রামবাংলায় কমে আসছে। সম্প্রসারিত তো হচ্ছেই না বরং ইট-ভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য ব্যাপকভাবে খেজুর গাছ কেটে নেয়া হচ্ছে।
কপোতাক্ষ নদের পাড়ে এখনো যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তৈরি খেজুর গুড় থেকে বাদামী চিনির সেই কলটির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৮৬১ সালে ইংল্যান্ডের মি. নিউ হাউজ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে খেজুর গুড় থেকে বাদামী চিনি তৈরি শুরু করেন। সে সময় বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। যশোরের তাহেরপুরের খেজুর গুড়ের বাদামী চিনি শুধু দেশে নয় বিদেশেও ব্যাপক চাহিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
১৮৬১ থেকে একটানা ১৮৮০ সাল পর্যন্ত কারখানাটি চলে। পরে এর হাল ধরে ইংল্যান্ডের এমেট এন্ড চেম্বার কোম্পানি। তারা ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত কারখানাটি চালু রাখার পর বন্ধ করে দেয়। সেই বন্ধই শেষ বন্ধ হয়েছে। ১৯১৫ সালে একবার চালুর চেষ্টা করেও সফল হয়নি সংশ্লিষ্টরা। কারখানার ধ্বংসস্তুপ এখন কলের সাক্ষী হিসেবে রয়েছে তাহেরপুরে।
খেজুরের গুড় শিল্পকে ঘিরে সেই সময় অনেক দেশী-বিদেশী বণিক আসতেন যশোরে। কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে খেজুরের রস ও গুড় ব্যবহার হওয়ায় এর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। বড় বড় জাহাজ ভর্তি হয়ে যশোরের বাদামী চিনি রফতানি হত বিদেশে। কাড়ি কাড়ি বৈদেশিক মুদ্রা আসত। এসব এখন গল্পকাহিনীর মতো মনে হবে নতুন প্রজন্মের কাছে।
তখন খেজুর গাছিদের মধ্যে যে প্রাণচাঞ্চল্যতা ও উচ্ছলতা ছিল, এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। যদিও আবার সেই দৃশ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। গাছীরা কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক নয়। এরা সাধারণ গৃহস্থ। গাছীদের পেশা মৌসুমী। এরা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের।
আরও দেখুনঃ