ছুতার বাংলাদেশের পেশাজীবী

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ছুতার বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।

ছুতার বাংলাদেশের পেশাজীবী

প্রাচীন বাংলায় ছুতার সবার পরিচিত। কৃষি প্রধান দেশে কৃষকের লাঙ্গল, জোয়াল, ম‍ই ইত্যাদি তৈরি করতো ছুতার। সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ির আসবাবপত্র তৈরি করতো ছুতার। নৌকা, ডোঙ্গা, গরুর গাড়ীও তৈরি করতো ছুতার। মধ্যযুগে বাংলার সর্বত্র ‘ছুতার’ বা ‘সূত্রধর’ শ্রেণীর যথেষ্ট চাহিদা ছিল।

তৎকালীন নদীমাতৃক বাংলার জলপথের প্রধান অবলম্বন ছিল নৌকা। ব্যবসা-বাণিজ্য দেশ ভ্রমণ এবং বর্ষাকালে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের কাজে নৌকাই ছিল সম্বল। তোফায়েল আহমদ রচিত ‘আমাদের প্রাচীন শিল্প’ গ্রন্থে রাজধন, অশ্ব ও রমনী বহনকারী ‘সর্বনন্দিরা, বর্ষায় রাজসভাসদে প্রমোদতরী ‘মধ্যমন্দিরা ও প্রবাসযাত্রা এবং যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করার জন্য ‘অগ্র মন্দিরা’ নামক তরণী।

 

ছুতার বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

এছাড়া সেসময় ক্ষুদ্রা, মধ্যমা, ভীমা, চপলা, পটলা অভয়া, দীর্ব্বা, পুত্রপুটা গর্ভরা ও মন্থরা প্রভৃতি দশপ্রকার ছোট নৌকা দেখা যেতো। বড় ধরনের নৌকাও ছিলো।

এগুলো দীর্ঘিকা, তরণী, লোলা, গড়য়া, গামিনী, তরী, জঘলা, প্লাবিনী, ধরনী ও বেগীনী। মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যে যেসব নৌযানের উল্লেখ পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে—মধুকর, রাজবল্লভ, রাজশংস, সমুদ্রকেন, শঙ্খচূড়, উদয়তথা রত্নপতি, ময়ূরপঙ্খী, কালরেখা প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব নৌকার আকার ছিল বিভিন্ন ধরনের। নানারকম অলংকরণে নৌকাগুলো ছিল চিত্রিত।

নৌকার গুলুই নানারূপ জীবজন্তুর মুখের আকারে নির্মিত হত। বহু মূল্যবান প্রস্তুর হাতীর হাত স্বর্ণ ও রৌপ্য দ্বারা এসব গুলুই নির্মাণ করা হতো। কাঠাল, পিয়াল, শাল, গাম্ভী তমাল প্রভৃতি কাঠ দিয়ে নির্মিত। নৌকা তৈরির এ সমস্ত বর্ণনা থেকে তৎকালীন সুতারদের দক্ষতা সৌন্দর্য মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

সংস্কৃত সূত্রধর শব্দ থেকে গ্রাম বাংলায় ছুতার কথ্যেরূপ হিসেবে ব্যবহৃত। ছুতাররা প্রাচীন কাল থেকেই কাঠের কাজে নিয়োজিত। এজন্য এদের ‘কাঠমিস্ত্রিও’ বলা হয়। রূপরাম চক্রবর্তী ছুতারদের পেশা সম্পর্কে বলেন-

বড় বড় গাছ কেটে ছুতার কামার

পথ করে চৌদিগে বেগারি বেলদার

মানিকরাম গাঙ্গলি ধর্মমঙ্গলে ছয়জন ছুতারের কথা উল্লেখ করেন, যাদের পেশা কাঠকাটা— “কাঠকুটা করা দেয় ছুতার ছয়জন”

অস্ট্রিকদের সময় থেকে বাংলাদেশে কৃষিকাজ প্রচলিত ছিল। ছুতার ছাড়া বাংলার কৃষক জমিতে লাঙ্গল দিতে পারতো না। কৃষকের প্রধান যন্ত্র লাঙ্গল ছুতারই তৈরি করতো। ছুতার কৃষকের লাঙ্গল, মই, জোয়াল, ইত্যাদি তৈরি এবং মেরামত করে থাকে। নদী পথে চলাচলের প্রধান বাহন ছিল নৌকা। বাংলাদেশে ছিল বিভিন্ন আকৃতি এবং নক্সার বিভিন্ন নৌকা।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

প্রচলিত ছিল গরুর গাড়ির এসব তৈরি করতো বাংলার ছুতার সম্প্রদায়। ছুতাররা নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। গ্রামাঞ্চলের ছুতার বাড়ি সবারই পরিচিত। বাংলায় টিনের প্রচলনের ফলে ছুতাররা টিনের ঘর তৈরির কাজও করতো। ছুতাররা টিনের ঘরের কাঠের কাঠামো তৈরি করতো। ঘরের কারুকার্যময় দরজা-জানালাও তাদের হাতের তৈরি। অনেক দক্ষ ছুতার প্রাচীনকাল থেকেই খাট-পালঙ্ক তৈরি করতো।

সে সমস্ত খাট-পালঙ্কে সুন্দর সুন্দর কারুকার্যও করতো। ছুতাররা কাঠের পিড়ে, জলচকি, চকি, চেয়ার, বেঞ্চ এ সমস্ত জিনিসপত্রও তৈরি করতো। ছুতাররা হাতুড়ি, করাত, রেদা, বাশাইল, বাটাল, বর্মা, সাঁড়াশি ইত্যাদি ব্যবহার করে। বাংলার ছুতার হরেক রকমের নৌকা বানাতে পারতো। এসমস্ত নৌকার গঠন, আকৃতি এবং কারুকার্য ছুতারদের দক্ষতার পরিচায়ক।

শিল্পের উৎপাদন হিসেবে কাঠের ব্যবহার পাথরের ব্যবহারের তুলনায় প্রাচীনতম বলে কেউ কেউ মনে করেন। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থাবলীতে মূর্তি তৈরির উপাদান হিসেবে কাঠকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হতো। জাতীয় যাদুঘর ও সোনারগাঁ লোকশিল্প যাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন কাঠের মূর্তি এদেশে ছুতার সম্প্রদায়ের শিল্পনৈপুণ্যের স্বাক্ষর।

ড. দীনেশচন্দ্র সেন সাতক্ষীরায় একটি মন্দির চতুর্দশ শতাব্দীর মনোরম চারুশিল্পের একটি নিদর্শন আছে বলে বৃহৎ বঙ্গ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। কাঠের তৈরি বাড়ি-ঘর, আসবাবপত্র, নৌকা, ঠাকুরের সিংহাসন, পুতুল কাঠ শিল্পের কারুকার্যময় উদাহরণ। ঘরের চার দিকের বেড়া, দরজা, জানালা কড়ি, বর্গা প্রভৃতি প্রাচীনকালের বিত্তবানেরা কাঠ দিয়ে তৈরি করাতেন।

 

ছুতার বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

ঘরে কাঠের বীমের মাথায় সিংহ, হাতির মুখ, পদ্ম এবং ব্রাকেটে মকর প্রভৃতি ছুতারদের খোদাই করা কাঠের কাজের প্রতীক। কাঠের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় খোদিত সিন্ধুকে। বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর প্রভৃতি অঞ্চলে এ ধরনের কাঠের নকসা করা সিন্ধুক দেখা যায়। এ সমস্তই আমাদের দেশের সেকালের কাঠমিস্ত্রিীদের কৃতি। অতীতে পালঙ্কের পায়া বাঘ সিংহের থাবার মতো, কখনো তা পরীর মতো করে খোদাই করা হতো।

গ্রামাঞ্চলে সচরাচর এক জোড়া ময়ূর দিয়ে খাট-পালঙ্কের সিরানা অলঙ্কৃত হতো। অতীতে ময়ূরপঙ্খী, টিয়াঠোটি প্রভৃতি নামের নৌকা তৈরি হতো। ঠাকুরের সিংহাসন বানাতে সূত্রধরেরা তাদের শিল্পশৈলীর পরম সৌকর্য দেখিয়েছে। বিভিন্ন লতাপাতা ও নকশায় প্রাচীনকালে কাঠের পালকী চিত্রিত করা হতো। বর্তমানে ছুতাররা কাঠের আধুনিক কারুকার্যময় আসবাবপত্র তৈরি করছে।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment