তাঁতি বাংলাদেশের পেশাজীবী

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় তাঁতি বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।

তাঁতি বাংলাদেশের পেশাজীবী

তাঁতী/জোলা/তন্তুবায় মানেই চরকায় সুতাকাটা ও সুতাপাকান। বাঁশ/কাঠ/দড়ির তৈরি হাত/পায়ে চালিত মেশিনের সাহায্যে ঘরে তৈরি কাপড় প্রস্তুতকারী সমাজ।

আদিম যুগের মানুষেরা বনে জঙ্গলে বাস করতো। গাছ-গাছালীর লতা-পাতা, পশুর চামড়া, পাখির পালক দিয়ে তারা লজ্জা নিবারণ করতো। কালক্রমে কৃষি যুগের সূচনা হয়। কৃষকের উৎপাদিত তুলায় কাপড় তৈরি শুরু হয়। মানুষ কাপড় পরতে শেখে। পোশাক মানুষকে সভ্য করে তোলে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রাচীনকাল থেকেই। বাংলাদেশে কাপড় তৈরি হতো।

তখনকার দিনে বাংলাদেশের তাঁতীরা হাতেই কাপড় তৈরি শুরু করে। বাংলাদেশে যারা হাতে কাপড় বোনে তারাই সমাজে তাঁতী/তন্তুবায়/ জেলে হিসেবে পরিচিত। জোলা মুসলমান সমাজে পরিচিত। তত্ত্ববায় তাঁতী হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উপবর্ণ। চর্যাগীতিতে শিল্পী শ্রেণীর মধ্যে তন্তুবায় সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।

 

তাঁতি বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

বৃহদ্ধর্ম পুরান এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে শিল্পীদের তালিকায় তন্তুবায় শ্রেণীর নাম পাওয়া যায়। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গলে প্রথম তিনশত কারিকর এবং এগারশত তাঁতীর পরিচয় পাওয়া যায়। কালকেতুর গুজরাট নগরী স্থাপিত হলে সেখানে শত শত তন্তুবায়ের আবির্ভাব ঘটে।

শত শত একবায় গুজরাটে তত্ত্ববায়

ভুনি খুনি ধুতি বোনে গড়া।

প্রাচীন বাংলার মানুষ ব্যবহার করতো ধুতি, লুঙ্গি, তবন, গামছা, শাড়ি। বাংলার তাঁতীরা এগুলো নিজ হাতে সাদামাটা যন্ত্রপাতির সাহায্যে তৈরি করতো। জোলা নিচু বংশের মুসলমান। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতের লোক তাঁতের কাজের সাথে জড়িত ছিল এবং বর্তমানেও আছে। প্রাচীন কালে বাংলাদেশে প্রচুর তুলা উৎপাদন হতো।

বাংলাদেশে কার্পাস, রেশম থেকে সুতা তৈরি করা হতো। কার্পাস অস্ট্রিক শব্দ। সুতরাং অনুমান করা হয় প্রাচীন অস্ট্রিকদের আমল থেকেই এদেশে কার্পাসের চাষ হয়ে আসছে। সে সময় কার্পাস থেকে বস্ত্র তৈরি হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পূর্ববঙ্গের উৎপন্ন ‘কার্পাসিক’ বস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রাচীন বাংলার ঘরে ঘরে চরকার সাহায্যে সুতা কাটা হতো। সুতাকাটার কাজটি করত প্রধানত মেয়েরা। এদেশের প্রাচীন সাহিত্যে, লোকসঙ্গীত এবং প্রবাদ প্রবচনে চরকার বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁত চালাতো পুরুষেরা। মেয়েরা সুতা কাটায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। কার্পাসের তুলা ছিল মসলিন কাপড় তৈরির জন্য বিশেষ উপযোগী। তুলার বীজ ছাড়ান হতো ‘চরকি’ দিয়ে। উৎকৃষ্ট তুলা পেজার জন্য ছিল ‘ডলন কাঠি’।

এরপর বোয়াল মাছের চোয়ালের কাটা দিয়ে তুলা আঁচড়িয়ে পরিষ্কার করা হয়। পরে একটি নলের কেসের ভেতর তুলা পুরে হাতে সুতা কাটা হতো। সূক্ষ্মসুতা কাটা হতো ভোর বেলা। উৎকৃষ্ট ঢাকাই মসলিনের সুতা বাতাসের আর্দ্রতার জন্য সূর্য ওঠার আগেই কাটা হতো। অজ্ঞাতনামা এক লেখক বলেছেন তাঁর সামনে এক পাউন্ড সুতা মাপা হয়।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এ সুতা দু’শ পঞ্চাশ মাইল লম্বা হয়েছিল। সুতা কাটা হলে তা’ ‘ফোটী’তে রাখা হতো। পরে পানিতে ভেজানো হতো এবং সুতা রাঙানোর জন্য কুসুমফুল রঞ্জক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কবি বিজয়গুপ্ত বাংলাদেশের তত্ত্ববায় সমাজের প্রশস্তি গেয়েছেন।

অনুমান করা হয় অস্ট্রিক যুগে পঞ্চদশ শতকে এ শিল্পকর্মের সূচনা। পরবর্তীকালে দ্রাবিড় সভ্যতার সময়েও বাংলাদেশের বয়নশিল্পীদের কাজ অব্যাহত ছিল। এ কারণেই বয়নশিল্পে বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সম্মান অর্জন করেছিল। মনুসংহিতার বর্ণনামতো প্রাচীনতম মসলিনের উৎপাদন বাংলাদেশেই হতো।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উৎপন্ন ক্ষোম, দুকূল, পত্রোর্ণা ও কার্পাসিকা নামক বস্ত্রের উল্লেখ আছে। এদেশের উৎপন্ন কার্পাস বস্ত্র গ্রীস, রোম, আরব, পারস্য, মিসর প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হতো। রেশমী শাড়ি সেকালে পট্টবস্ত্র নামে পরিচিত ছিল। তখন কলাপাট, অগ্নিপাট, কাঞ্চাপাট প্রভৃতি ধরনের রেশমী কাপড় বুনোন করা হতো।

গরীব মানুষেরা ক্ষোম, ক্ষেমী, ক্ষেণি বা খুঁইয়া নামে পরিচিত মোটা লিলেন কাপড় পরতো। পর্তুগীজ পরিব্রাজক বারবোশা ১৫১৮ সালে বাংলাদেশে আসেন। তিনি এদেশের তাঁতীদের তৈরি মেমেনো, দু’গজা, চৌতারী, সিনাবাফা এবং বটিলহা কাপড়ের উল্লেখ করেছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৭০ সালে

ঢাকা, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ ও বাজিতপুরের তাঁতীদের তৈরি বস্ত্র শিল্প সম্পর্কে এক ফিরিস্তি দেন। কোম্পানির বর্ণনায় সিঙ্গাহাম, কশা, মলমল, রেশমী, নীলা, টফেটা ও রেশম বস্ত্রের উল্লেখ করেন।

পাবনায় তন্তুবায়, কাপালি ও কারিগরদের তৈরি ‘মিহি উড়নি’ ও ‘পাবনাই পাইর’ বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিল। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর তাঁতীদের মলমল ও খাসা বিখ্যাত কাপড় ছিল। কুমিল্লার তাঁতীদের তৈরি ময়নামতী শাড়ি, টিপরাদের তৈরি পাহাড়ী তুলা ও কার্পাসের ময়নামতীর চেক, সরাইলের তানজেব কাপড় মনোরম ও চিত্তাকর্ষক ছিল।

বাংলাদেশের তাঁতীদের তৈরি জামদানি সবার কাছে সমাদৃত। জামদানি তৈরিতে একটি ঘরে এক বা একাধিক তাঁত স্থাপন করা হয়। কয়েকটি বাঁশ কাঠের খণ্ড দিয়ে তৈরি সাধারণ তাঁতে জামদানি তৈরি করা হয়। জামদানির তাঁত কাঠের বীম, বাঁশের মালসী, বাঁশের সুতি কাটনী, সুতি কাঁটা, সানা, বাঁশের চিরুনীর মত সলা, দকতী, ইত্যাদি যন্ত্রপাতি লাগে। তাঁতের নিচে তাকে হাঁটু সমান গর্ত।

পায়ের চাপে সরু তল ওঠানামা করে। ‘মাকুতে’ থাকে সুতা প্যাচানো ‘নলী’। হাতে মাকু চালিয়ে জামদানি তৈরি করা হয়। হরেক রকমের নকসার জামদানি তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের জামদানি বর্তমানেও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। তাঁতীদের কাজ মূলত হাত ও পায়ের। এ সংক্রান্ত একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে—

তাতে যোগী,গাতে পাউ

কুল্লে যোগী,হিয়ালের ছাউ

অর্থাৎ হাত ও পায়ের কাজের ওপর তাঁতীর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।

 

তাঁতি বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

ইংরেজ শাসন আমলে তাঁতীদের তৈরি কাপড় রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এদেশের তাঁতীদের ওপর ইংরেজরা জুলুম আর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করে। বাংলাদেশের হাতে তৈরি তাদের কাপড়ের ওপর অতিরিক্ত কর বসান হয়। পক্ষান্তরে ইংল্যান্ডের কলের তৈরি কাপড় এদেশে আমদানি হতে থাকে। ফলে এদেশে তাঁতীদের তৈরি কাপড়ের উৎপাদন ভেঙ্গে পড়ে।

যান্ত্রিক উৎপাদনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিযোগিতায় বাংলার তাঁতীদের হস্ত নির্মিত বস্ত্রশিল্প অনিবার্য বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। ১৯৪৭ সালে ভারতে ইংরেজদের রাজত্বের অবসান ঘটে। ফলে ইংল্যান্ডের বস্ত্র ভারতে আমদানি বন্ধ হয়ে যায় এ-পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলাদেশ তাঁত বস্ত্রের উৎপাদন আবার দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।

তাঁত শিল্প বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক শিল্প এবং পাড়া ভিত্তিক। তাঁতী পাড়াসমূহ বিশেষ বিশেষ অঞ্চল ছাড়া প্রধানত গ্রামের এক অংশে বসবাস করতো।নরসিংদি, রায়পুরা, ডেমরা, টাঙ্গাইল, শাহজাদপুর, বেড়া, কুমারখালি, রুহিতপুর, গৌরনদী, মীরগড়, নাসির নগর প্রভৃতি অঞ্চলে তাদের বাস।

তাঁতীরা বর্তমানে – শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, মশারি, তোয়ালে, মল বস্ত্র উৎপাদন করে। বাংলাদেশের তাঁতীদের ঢাকাই শাড়ি, পাবনা শাড়ী ও টাঙ্গাইল শাড়ীর বয়ন পদ্ধতিতে আঞ্চলিক নৈপুণ্যের ছাপ রয়েছে। ঢাকার মিরপুরে জামদানি, বেনারসী ইত্যাদি কাপড় বিশেষভাবে সমাদৃত।

জয়পাড়া, রুহিতপুর, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, রামচন্দ্রপুর, দুলালপুর, সিরাজগঞ্জ, সাদুল্লাপুর, বাবুরহাট, কুমারখালি, নরসিংদী প্রভৃতি বাজারে তাঁতীদের তৈরি শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা, ইত্যাদি কেনা বেচা হয়। তাঁতীরা হাটবাজারে তাঁদের উৎপাদিত কাপড় বিক্রির জন্য উপস্থিত হয়। ফড়িয়া, মহাজনেরা তাঁতিদের কাছ থেকে কাপড় কিনে থাকে।

পৃথিবী বিখ্যাত মসলিন শাড়ি বাংলার তাতীদের তৈরি। রাজশাহীর সিল্ক, রেশমী কাপড়, টাঙ্গাইলের সূতীর শাড়ি। মিরপুরের জামদানী, কাতান-ডেমরার বেনারশী নরসিংদির লুঙ্গি-গামছা-পাবনার শাড়ি লুঙ্গি-কুমিল্লার খদ্দর-সারা বাংলায় সমাদৃত। টাঙ্গাইলের সূতী শাড়ি বাংলার মহিলাদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। টাঙ্গাইলের সিল্ক বাংলার সীমানা পেরিয়ে রপ্তানি শুরু হয়েছে। এ সমস্ত কাপড় বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে ‘ঢাকা চেক’ তাতীদের তৈরি।

ঢাকা চেকের তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। অনেক তাঁতীদের নিজস্ব তাঁত আছে। অনেকে অন্যের তাতে কাজ করে। বাংলাদেশের তাঁতের শাড়ির রঙ, ডিজাইন ইত্যাদির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। দেশ-বিদেশে তাতের শাড়ীর চাহিদাও বেড়েছে। তাত বস্ত্র বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধশালী কুটির শিল্প।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment