আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পাটনি বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।
পাটনি বাংলাদেশের পেশাজীবী
প্রাচীন বাংলায় একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াতের কথা হলেই ভেসে উঠতো নদী-নালা- খাল পারা পায়ের চিত্র। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিলে ভরা বাংলাদেশ। মোগল, ব্রিটিশ শাসন আমলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে গ্রাম বাংলার অনেক নদী— খাল পারাপারের জন্য নদী বা খালের ওপর ‘সাঁকো’ বা ‘চার’ তৈরি করা হতো।
নদী একটু বড় হলে সেখানে নৌকায় নদী পারাপারের ব্যবস্থা ছিল। খেয়া মাঝি বা পাটনি এ ব্যবস্থা করত। পাটনি সাধারণত নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। এরা নদ-নদী, খালের যেখানে‘সাঁকো’ বা ‘চার’ থাকতো সাধারণত এর আশপাশেই বাস করত।
আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে যখন এদেশে তেমন রাস্তা-ঘাট ছিল না সে সময় পাটনিরা নদী-খাল পারাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। মোটা বাঁশ এবং বাঁশের চটা’, গুণা, পেরেক, তার ও কাতা দিয়ে এরা সাঁকো বা ‘চার’ তৈরি করত।
চারে পারাপারের কড়ি হিসেবে চারের এপাড় ওপাড়ে বসবাসরত গৃহস্থের কাছ থেকে পাটনিরা ধান মৌসুমে ধান এবং পাট মৌসুমে পাট সংগ্রহ করত। অনেকে ধান-পাটের পরিবর্তে বাৎসরিক হিসেবে টাকা-পয়সাও দিত। পাটনিদের নিকট চার পারাপারের লোকজন পরিচিত ছিল।

অপরিচিত লোক চার বা সাঁকো পার হতে চাইলে তাদের কাছ থেকে নগদ পয়সা সংগ্রহ করত। এরা সাঁকো বা চারের প্রান্তে টোঙ ঘর তুলে পারাপারের যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা পয়সা সংগ্রহ করত। সাঁকো বা চার রক্ষণাবেক্ষণ করত পাটনিরা।
যে ঘাটে ‘সাঁকো’ বা ‘চার’ থাকত না সে ঘাটে খেয়া মাঝি/পাটনি নৌকার সাহায্যে পারাপারের যাত্রীদের নগদ টাকা/পয়সার বিনিময়ে নদী পার করাত। পাটনিরা এলাকার জনগণের নিকট পরিচিত ছিল। পাটনি মাঝিদেরই একটি বিশেষ সম্প্রদায়।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ‘চর্যাপদ’ এবং মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যেও পাটনিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রতিটি নদী খালের ঘাট সরকারিভাবে ‘ডাক’ হতো। পাটনিরা ঘাটের বছর ভিত্তিক ইজারা নিত। পাটনিরা খেয়া পারাপারের কাজ করে রাজকর আদায় করত। পাটনি নগরে বৈসে রাত্রি দিন জলে ভাসে পার করি লয় রাজ করে।
মধ্যযুগের সাহিত্যে একমাত্র খেয়াঘাট ছাড়া আর কোথায়ও ‘রাজকর’ আদায়ের উল্লেখ নেই। এ প্রসঙ্গে ভারতচন্দ্র অঙ্কিত ‘ঈশ্বর পাটুনি’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যে পাটনি/মাঝিদের নিয়ে গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে ছায়াছবি। বর্তমান নদী-নালা-খালের ওপর ব্রীজ/কালভার্ট নির্মিত হওয়ায় পাটনীদের কাজ ও পেশা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। পাটনি পেশা বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে।
আরও দেখুনঃ