প্রেষণা, প্রেষণা ও প্রেষণার বৈশিষ্ট্য

প্রেষণা, প্রেষণা ও প্রেষণার বৈশিষ্ট্য আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বাউবি এসএসসি ২৩৫৮ ক্যারিয়ার শিক্ষা” এর  “ক্যারিয়ার গঠনের উপাদান ও কৌশল” ইউনিট ২ এর অন্তর্ভুক্ত।

 

প্রেষণা, প্রেষণা ও প্রেষণার বৈশিষ্ট্য

প্রাণীর অন্তর্নিহিত শক্তি যেভাবে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য গতি লাভ করে এবং নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত হয় তাকে প্রেষণা বলে। সেজন্যই প্রেষণাকে আচরণের চালিকা শক্তি বলে। যে কাজ ব্যক্তির কোন ইচ্ছাকে পূরণ করতে সমর্থ হয় সে ঐ কাজটিই করতে উৎসাহ বোধ করবে।

সুতরাং দেখা যায় যে, প্রেষণা ব্যক্তির আচরণে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে এবং সময় ও স্থান বিশেষে কোন কোন আচরণের সংঘটনের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। এই পাঠে প্রেষণা, প্রেষণা চক্র এবং প্রেষণার বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হবে। প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ, চলুন আমরা নিচের গল্পটি পড়ি।

রুবাব ও যারিন দুই বোন। তারা দুই বোন ওয়াইজম্যান স্কুল এ্যান্ড কলেজের ছাত্রী। গ্রীষ্মের ছুটিতে তারা বাবা মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে রওনা হয়। ঢাকা থেকে তারা অভি এন্টার প্রাইজে সিরাজগঞ্জ শহরে যায়। এরপর তারা রিক্সা করে শিয়ালকোল বাজারে পৌঁছায়। শিয়ালকোল থেকে তারা পায়ে হেটে বড় হামকুড়িয়া গ্রামের দিকে রওনা হয়। কিছু দূর যেতেই রুবাব তৃষ্ণা অনুভব করে। কিন্তু তারা ভুলে পানির বোতল গাড়িতে ফেলে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে রুবাবের পিপাসা আরও বেড়ে যায়। আসেপাশে কোন বাড়ি না থাকায় কোথাও পানির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না ।

এমন অবস্থায় সে তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকে এবং পানি খুঁজতে থাকে। একটু সামনে যেতেই রুবাব দেখতে পায় গভীর নলকূপের পানি দিয়ে কৃষক জমিতে সেচ দিচ্ছে। সে রাস্তা থেকে নেমে দৌড়িয়ে নলকূপের কাছে যায় এবং দুই হাতে পানি নিয়ে পান করে। পানি পানের পর রুবাব অনেক আরাম অনুভব করে। এরপর সে সবার সাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় ।

 

নেতার গুণাবলি প্রেষণা, প্রেষণা ও প্রেষণার বৈশিষ্ট্য

 

শিক্ষার্থী বন্ধুরা, আপনারা কি বলতে পারেন রুবাব কেন ছোটাছুটি করতে ছিল। হ্যাঁ বন্ধুরা, রুবাব তৃষ্ণার্ত থাকায় পানি পানের জন্য ছোটাছুটি করতে ছিল। বন্ধুরা, তৃষ্ণার্ত হবার পর রুবাবের পানি পানের জন্য যে কর্ম প্রচেষ্টা এটাই হল প্রেষণা। প্রেষণা শব্দটির উৎপত্তি বাংলা প্রেষ শব্দ থেকে যার অর্থ চাপ। মনোবিজ্ঞানে প্রেষণা শব্দটিকে অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। প্রেষণা এমন একটি অবস্থাকে বুঝায় যা মানুষকে কোন আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে বা তাকে ঐ আচরণের দিকে চালিত করে।

আমাদের চাহিদা বা অভাববোধ থেকে মনের ভেতরে বা বাইরে চাপ সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য মনে যে তাড়না, তাগিদ বা উদ্যম সৃষ্টি হয় তাকেই প্রেষণা বলা হয় । প্রেষণা সৃষ্টির মূলে রয়েছে কোন কিছুর অভাব, এবং সেই অভাব দূর করার জন্য ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের শক্তি বা তাড়নার সৃষ্টি হয় যা তাকে ঐ অভাব পূরণ করার লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়। তাছাড়া অভাব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে তার মধ্যে অভাব পূরণের উপায় সম্পর্কে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়, একে বলে উদ্দেশ্য। অতঃপর সে ঐ উদ্দেশ্যমূলক আচরণ করে অভাব পূরণ করে অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তু অর্জন করে।

প্রাণীর জীবনে প্রেষণার এই অবস্থাগুলিকে ধারাবাহিকভাবে সাজালে নিম্নরূপ একটি চিত্র পাওয়া যায়, একে বলে প্রেষণার চেইন বা শিকল। আবার এই শিকলকে চক্রাকারে সাজালে যা পাওয়া যাবে তা হল প্রেষণা চক্র।

চাহিদা → তাড়না → উদ্দেশ্য → আচরণ → লক্ষ্য অর্জন → চাহিদার পরিসমাপ্তি →

প্রেষণা একটি অবিরাম প্রক্রিয়া কারণ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রাণীর অভাববোধ থেকেই যায়, তা কখনো শেষ হয়না। অতএব এক প্রেষণার পরিসমাপ্তি হলে অপর প্রেষণার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ মানুষ আবার আর একটি প্রেষিত আচরণের জন্য সক্রিয় হয়। এভাবে তার জীবনব্যাপী কোন না কোন প্রেষিত আচরণ চলতেই থাকে ।

প্রেষণার উৎস

অপরিতৃপ্ত মানসিক ও জৈবিক চাহিদা মানুষের মনে একটি অস্থিরতা সৃষ্টি করে, এই অস্থিরতার ফলে মানুষের আচরণে তাড়নার সৃষ্টি হয়। যতক্ষণ না তার চাহিদার তৃপ্তি ঘটে ততক্ষণ এই তাড়না ক্রিয়াশীল থাকে। অতএব অভাববোধ বা চাহিদাই প্রেষণার প্রাথমিক উৎস। জৈবিক বা শারীরিক চাহিদাগুলো হলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, পানীয়, বিশ্রাম, চঞ্চলতা, যৌনাকাঙ্ক্ষা, আলো, বাতাস, মল-মূত্র ত্যাগ ইত্যাদি। মানসিক চাহিদা হলো স্বীকৃতি, নিরাপত্তা, প্রেম, ভালবাসা, কৌতুহল, সৌন্দর্য পিপাসা, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ইত্যাদি। এই সব চাহিদা থেকে আমাদের বাসনা, ইচ্ছা, অনুরাগ বা আকাঙ্খা সৃষ্টি হয় এবং কোন কিছু অর্জনের জন্য চালিত করে। প্রেষণার ফলে সৃষ্ট চাহিদা শক্তি মানুষের সকল কর্মপ্রেরণার উৎস।

প্রেষণা চক্র

প্রেষণা-চক্রের প্রাথমিক অবস্থায় প্রাণী বা মানুষ কোন কিছুর অভাবজনিত কারণে অস্থিরতা অনুভব করে, তারপর তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রাণী বা মানুষ কতগুলো আচরণ করা, সবশেষে কাংঙ্ক্ষিত বস্তুটি পেলেই সেই অস্থিরভাব দূর হয় এবং সে তৃপ্তি লাভ করে। কিছু সময় পরে, প্রাণী বা মানুষের আবার প্রেষণা সৃষ্টি হয়। এভাবেই প্রেষণা চক্র আবর্তিত হয়। চিত্রটি লক্ষ করুন:

প্রেষণার বৈশিষ্ট্য

আমাদের শরীরে পানির অভাববোধ থেকেই আমরা তৃষ্ণার্ত হই। আমরা পানি পান করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ি বা অস্থির হয়ে পড়ি। এটি হলো প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপে পানি পাওয়ার জন্য এবং পান করার জন্য আমরা কিছু আচরণ করে থাকি । পানি পান করাতে তৃতীয় ধাপে আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। আমরা পরিতৃপ্ত হই। কয়েক ঘণ্টা যাওয়ার পর শারীরিক প্রয়োজনে আমরা আবার পানির অভাব বোধ করি এবং তৃষ্ণার্ত হই। আমরা আবার পূর্বের ন্যায় আচরণ করে থাকি। এভাবেই আমাদের আচরণ আবর্তিত হয় বিশেষ কোন প্রেষণাকে ঘিরে ।

প্রেষণার বৈশিষ্ট্য

মানুষের মধ্যে যেকোন আচরণ সংঘটিত হলেই যে তা প্রেষিত হবে তা বলা যায় না। কারণ সব আচরণই প্রেষিত না হয়ে অন্য কিছু হতে পারে । প্রেষিত আচরণ হওয়ার জন্য যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে যদি সেগুলি আচরণের পেছনে না থাকে তবে তাকে প্রেষিত আচরণ বলা যাবেনা। নিচে প্রেষণার এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করা হল :

১. ব্যক্তিগত চাহিদা থেকেই প্রেষণার সৃষ্টি: ব্যক্তি নিজে থেকেই কোন কিছুর অভাব বোধ না করলে তার মধ্যে কোন প্রেষণার সৃষ্টি হবে না। তবে এই অভাববোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবেও নিজের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে অথবা বাহ্যিক চাপের ফলেও তা হতে পারে। যেমন, ব্যক্তি যখন অনুভব করে যে তার ক্ষুধা পেয়েছে তখনই সে খাদ্যের সন্ধানে বের হবে।

২. প্রেষিত আচরণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়: প্রেষণা মানুষ বা প্রাণীকে কোন বিশেষ লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করে। অর্থাৎ সে কী করতে চায় সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে যেমন, ক্ষুধা বোধ করলে মানুষ কেবল খাদ্যেরই সন্ধান করবে, পানির সন্ধান করবেনা ।

৩. প্রেষিত আচরণ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে: যে অভাব থেকে প্রেষণার সৃষ্টি হয়েছে তা যদি পুরণ করতে দীর্ঘ সময়েরও প্রয়োজন হয় তবুও মানুষ ধৈর্যের সাথে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকবে।

 

Google news logo প্রেষণা, প্রেষণা ও প্রেষণার বৈশিষ্ট্য
আমাদের গুগল নিউজ ফলো করুন

 

 

সারসংক্ষেপ

প্রাণীর অন্তর্নিহিত শক্তি যেভাবে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য গতি লাভ করে এবং নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত হয় তাকে প্রেষণা বলে। প্রেষণা সৃষ্টির মূলে রয়েছে কোন কিছুর অভাব, এবং সেই অভাব দূর করার জন্য ব্যক্তির মধ্যে এক ধরণের শক্তি বা তাড়নার সৃষ্টি হয় যা তাকে ঐ অভাব পূরণ করার লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়। তাছাড়া অভাব সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে তার মধ্যে অভাব পুরণের উপায় সম্পর্কে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়, একে বলে উদ্দেশ্য। অতঃপর সে ঐ উদ্দেশ্যমূলক আচরণ করে অভাব পুরণ করে অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তু অর্জন করে। প্রাণীর জীবনে প্রেষণার এই অবস্থাগুলিকে ধারাবাহিকভাবে সাজালে নিম্নরূপ একটি চিত্র পাওয়া যায়, একে বলে প্রেষণার চেইন বা শিকল। আবার এই শিকলকে চক্রাকারে সাজালে যা পাওয়া যাবে তা হল প্রেষণা চক্র।

প্রেষণার বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:

১. ব্যক্তিগত চাহিদা থেকেই প্রেষণার সৃষ্টি।

২. প্রেষিত আচরণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়।

৩. প্রেষিত আচরণ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে ।

 

আরও পড়ুন….

Leave a Comment