বাংলাদেশের পরিবেশ ও পেশা 

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বাংলাদেশের পরিবেশ ও পেশা  ।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশের পরিবেশ ও পেশা

বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় পনের কোটি। এই পনের কোটি লোক হাজার রকম বৃত্তি বা পেশায় নিয়োজিত। সাধারণ অর্থে মানুষ যে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে সেই কাজকেই তার বৃত্তি বা পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়।

পেশার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে আর্থ- সামাজিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে। পেশা নির্ভর করে দেশের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি ওপর। ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষার হার, প্রযুক্তির অগ্রগতি পেশার উদ্ভব ও বিকাশের উপর প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে শিরা- উপশিরার মত রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল বিল, হাওড়-বাওড়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ুর রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এদেশের মাটি কৃষি- কাজের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। প্রাচীন অস্ট্রিক যুগ থেকেই এদেশে কৃষি কাজ চলে আসছে।

 

বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

বাংলাদেশের মাটিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের— পাহাড়িয়া মাটি। পাহাড়িয়া অঞ্চলের উপজাতিরা জুম চাষ করে। বরেন্দ্র ভূমির – পুরাতন পলল অঞ্চলের মাটি। গঙ্গা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকা এবং সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলসমূহের মাটি।

বাংলাদেশে প্রচুর সমতল পললভূমি থাকার কারণে এদেশে প্রাচীনকাল থেকেই কৃষিকাজ চলে আসছে। ধান বাংলাদেশের প্রধান কৃষি ফসল। এদেশের মাটি খুব উর্বর। অল্প পরিশ্রমেই কৃষক প্রচুর ফসল ফলিয়ে থাকে। এদেশের কৃষকরা পাট, তুলা, তামাক, তৈলবীজ, ইক্ষু ইত্যাদি ফসল উৎপন্ন করে থাকে। কার্পাস, রেশম, মরিচ ইত্যাদির চাষ হতো এদেশে।

বাংলাদেশের প্রচুর ফল উৎপন্ন হয়। হরেক রকমের ফল যেমন— আম, জাম, পেয়ারা, নারিকেল, আতা, লিচু, বেল, আনারস, কাঠালি, কুল, জাম্বুরা, কলা, পেপে, তরমুজ ইত্যাদি। কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ত কামার, ছুতার প্রভৃতি পেশার উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীনকাল থেকেই। কামার কৃষকের লাঙ্গলের ফলা, নিড়ানী, কাস্তে, আচড়া, কোদাল, টেঙ্গি ইত্যাদি তৈরি করে থাকে।

১৪০৬ সালে মাহুয়েন চট্টগ্রাম, সোনারগাঁও, বাঙ্গালায় গম, তিল, নানাজাতীয় কলাই, আদা, সরিষা, পালঙ, গাঁজা, বার্তাকু, কাঁঠাল, আম, দাড়িম্ব, ইক্ষু, কলা, নারিকেল ও তন্দুল জাতীয় ফল-ফলারি উৎপন্ন হতো বলে উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ ও আর্দ্র। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশে বছরে ১২০ থেকে ৬০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টির দরুন নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় পানিতে কানায় কানায় ভরে যেতো। এ সমস্ত জলাশয়ে উৎপন্ন হতো প্রচুর মাছ।

হরেক রকমের মাছ পাওয়া যেতো বাংলাদেশে৷ পুটি, খোলসা, ভেদা, টাকি, কাকিলা, পাপদা, টেংরা, শোল, বোয়াল, ইলিশ, কৈ, মাগুর, শিং ইত্যাদি মাছ। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ এ প্রবাদটি প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত ছিল। নদীমাতৃক এ দেশে প্রাচীন কাল থেকেই মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত ছিল জেলে সম্প্রদায়। সে সময় নদীই ছিল যাতায়াতের প্রধান পথ।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

নদীপথে চলত হরেক রকমের ছোট-বড় অসংখ্য নৌকা। আদিকাল থেকেই মাঝি সম্প্রদায় এদেশের মানুষের কাছে সুপরিচিত। বজরা, পানসী, জেলে ইত্যাদি নৌকা মাঝি-মাল্লারা চালাতো। পণ্য বোঝাই বড় বড় বজরা নৌকা চালিয়ে বিদেশে বাণিজ্যে যেত।

বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু কার্পাস ও রেশম চাষের উপযোগী। তাই সুপ্রাচীনকাল থেকে এদেশে বস্ত্র শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। এদেশে আবির্ভূত হয়েছিল তাঁতী সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশে বহু অঞ্চলে তাঁতীদের বসবাস ছিল। প্রায় প্রতি গ্রামেই চরকার ঘরঘর শব্দ শোনো যেতো। মেয়েরা সুতা কাটতো। পুরুষেরা তাঁত চালাতো।

বাংলাদেশ থেকে মেঘডুম্বুর, মসলিন, রেশমী ইত্যাদি শাড়ী বিদেশে রপ্তানি হতো। সুতাও সে সময় রপ্তানি করা হতো। বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে রয়েছে সুন্দরবন। রয়েছে চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া বনাঞ্চল এবং মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের বনাঞ্চল। এ সমস্ত বনাঞ্চলে প্রচুর কাঠ ও

মধু পাওয়া যায়। কাঠ সংগ্রহের কাজে বাওয়ালী এবং মধু ও মোম সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত আছে মৌয়াল। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে বাঁশ ও শন পাওয়া যেতো। বাঁশ-শনের ঘর তৈরি করতো ঘরামী। এদেশে নৌকা, গরুর গাড়ি, টিনের ঘরের প্রচলন ছিল প্রাচীনকাল থেকেই।

এ কাজের জন্য ছুতার, ঘরমী, করাতি পেশার অস্তিত্ব দেখা যায়। বাংলাদেশের ছুতাররা বেশ নিপুণ ও দক্ষ। তাদের হাতে বিভিন্ন আকৃতির কারুকার্যময় নৌকা, খাট— পালঙ্ক, ঘরের দরজা-জানালা ইত্যাদি তৈরি হতো এবং হয়ে আসছে।

অসংখ্যক উন্নত মানের কুটির শিল্প থেকে বাংলাদেশের জনগণ জীবিকা অর্জন করতো। হাতীর দাঁতের কাজের আদিভূমি সিলেট। সূচি শিল্পে ঢাকা অমর কীর্তি স্থাপন করেছিল। কাগজ শিল্পে ঢাকা, পাবনা, বগুড়া, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় প্রচুর অর্থাগম হতো। লাক্ষা শিল্পী ছিল গ্রামে গ্রামে। ঢাকার অলঙ্কার শিল্পীর, শাঁখারীর কুশলী হাত একদিন প্রসিদ্ধ ছিল।

কাঁসা-পিতলের কাজ, কঠের কাজ, রঞ্জন শিল্প, পাথর খোদাই এর কাজ, হাড়ি-পাতিল তৈরি, বাঁশ-বেতের কাজ, সুতা কাটা প্রভৃতি ক্ষুদ্র শিল্পে এদেশের প্রচুর লোক নিয়োজিত ছিল।

সেকালের চীনা পরিব্রাজকেরা এদেশে গালিচা, আগ্নেয়াস্ত্র, ইস্পাত, অলঙ্কার প্রভৃতি শিল্পের কথা উল্লেখ করেছেন। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও মজবুত তলোয়ার তৈরির জন্য এদেশের খ্যাতি ছিল। ব্রোঞ্জ, কাঠ ও পাথরের কাজে বাঙালিরা পারদর্শী ছিল। নানারকম মসলা ও সুগন্ধী তৈরি করতো গন্ধবণিকেরা।

বাংলাদেশের হস্তশিল্প প্রাচীনকাল থেকেই দেশ-বিদেশে আদৃত হয়ে আসছে। বাঁশ- বেতের জিনিসপত্র, হাতির দাঁতের তৈজসপত্র, কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র, স্বর্ণ ও শাখার অলঙ্কার ইত্যাদি জন্য শাখারু, স্বর্ণাকার, কাসারু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা যায় । প্রাচীনকালে বাংলাদেশের স্বর্ণালঙ্কার, হাতির দাঁতের তৈরি তৈজসপত্র বিদেশে রপ্তানি হতো।

বাংলার কৃষকের গোয়াল ভরা গরু ছিল। দুধ-ভাত বাঙ্গালি সন্তানের প্রধান খাদ্য। দুধ আর গরুর জন্য ছিল গোয়ালা শ্রেণী। আত্ৰা-শালিখা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম জেলায় শোলা, ভাতৃশোলা বা ফুল শোলা জন্মে। সৃষ্টি হয়েছে শোলা শিল্পী-মালাকারদের।

 

বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

বাংলাদেশের সিলেট, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী প্রভৃতি জেলায় প্রচুর মেরতা জন্মে। মেরতার জন্য এদেশে পাটিয়াল কারিগর দেখা যায়। প্রাচীনকালে সিরাজগঞ্জ, রংপুর, মানিকগঞ্জ জেলায় কাগজীরা কাগজ উৎপন্ন করতো।

বাংলাদেশের এটেল মাটি কুমার সম্প্রদায়ের বড় সম্পদ। প্রাচীনকাল থেকেই কুমারের হাড়ি, পাতিল, বাসন, ঠিলে, সানকি, কোলা ইত্যাদি বাংলাদেশে ব্যাপক প্রচলন ছিল। প্রাচীন মন্দির, বৌদ্ধবিহারে অনেক নকশাযুক্ত মাটির ফলক দেখা যায়। এগুলো এদেশের কুমার এবং মৃৎশিল্পের দক্ষতার পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশের জীবজন্তু ও গাছপালার বর্ণনা আরো বৈচিত্র্যময়।

টেলর সাহেব বহু জীবজন্তু ও পাখ-পাখালির চমকপ্রদ পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। এখানকার উদবিড়াল ও ভোঁদড়ের চামড়া চীনের রাজপুত্রদের পোশাক তৈরির জন্য, মাছরাঙা পাখির পালক ও অন্য বহু দ্রব্য ভুটান, চীন, বার্মা ও তিব্বতসহ পৃথিবীর বহু দেশে রপ্তানি করা হতো। এদেশের বন-জঙ্গলে বাঘ, চিতাবাঘ, হরিণ, হাতী, খরগোশ, সজারু, সাপ, ভাল্লুক ইত্যাদি নানা প্রকারের জীবজন্তু ও সরীসৃপ দেখতে পাওয়া যেতো।

দেখা যেতো নানা রঙের পাখি । মসলিন ও বুটি তোলা কাসিদা বস্ত্র—জেদ্দা, বসরা, মিসর, তুরস্ক এবং ইউরোপীয় দেশসমূহে। নীল, জাফরান, সুপারি, সাবান, চামড়া, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, শঙ্খবালা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকারাদি, তাম্রনির্মিত বাসন-কোসন, পনীর এবং সংরক্ষিত ফলমূল সাধারণত কলকাতা, আসাম, আরাকান ও রেঙ্গুন প্রভৃতি অঞ্চলে রপ্তানি করা হতো।

বাংলাদেশের গ্রামের লোকেরা কুড়েঘরে বসবাস করতো। কুঁড়েঘরের ছাউনিতে বন, উলুখড়, কাশ বা খাগড়ার ব্যবহার ছিল। গোখাদ্য ছিল দুবলা ও বক্ষা। গৃহস্থের লাঙ্গল তৈরিতে আম, হিজল, বড়ই ও পাবের ব্যবহার ছিল। তাঁতের মাকু, ডিঙ্গি নৌকা, জলযান ইত্যাদি তৈরিতে তালগাছ ; বাক্স-পেটরা, বারকোষ, পেয়ালা বিভিন্ন রকম বাসন-কোশন তৈরিতে কদম্ব ব্যবহার হতো। ঢেঁকি বানাতে গাব।

নৌকা, ঘরে খুঁটি ও কড়ে-বরগা তৈরিতে হরিতকি ও বয়রা। সিন্দুক, আলমারি ও চেয়ার নির্মাণে কাঠাল ইত্যাদি গাছ ব্যবহার করা হতো। অন্ত্যজ শ্রেণীর পেশাভিত্তিক স্তরগুলোও অবলোকন করেছেন। হিন্দুদের কামার, কুমার, ডোম, চণ্ডাল, পাটনী, পাটিয়াল, মালাকার, কৈবর্ত, সুগদ্ধবণিক, নাপিত, ধোপা প্রভৃতি। মুসলমানদের গারুরী, হাজাম, বেদে, ধোপা, বাজিকর, বেহারা, বাদ্যকর, সাপুড়ে প্রভৃতি।

বিভিন্ন শাসকদের শাসনামলে এদেশের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আর্যদের বর্ণ-উপবর্ণের ভিত্তিতে পেশা বা বৃত্তির বিভাজন হয়েছে। এ সময়ে বর্ণের ভিত্তিতে ধোপা, নাপিত, কামার, কুমার, ছুতার, ডোম, তাঁতী, জেলে প্রভৃতি সম্প্রদায়ের বৃত্তি নির্ধারিত হয়েছে। মুসলমান শাসনামলে এদেশে দর্জি, বাবুর্চি, কশাই, হাজাম ইত্যাদি পেশার আবির্ভাব হয়।

ব্রিটিশ শাসনামলে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, কোর্ট কাচারি প্রতিষ্ঠিত হয়। এদেশের সমাজ কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। প্রাচীন বাংলা, মধ্যযুগীয় বাংলা ও বর্তমানের বাংলাদেশে পনের কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার তাগিদে হরেক রকমের বৃত্তি/পেশার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে।

সমাজ পরিবর্তনের সাথে অনেক পেশার বিলুপ্তি ঘটেছে। নতুন নতুন পেশা/জীবীকার বিকাশ ঘটেছে। এখানে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় বংশপরম্পরায় প্রচলিত কয়েকটি পেশার আলোচনা করা হলো।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment