বারুই বাংলাদেশের পেশাজীবী

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বারুই বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।

বারুই বাংলাদেশের পেশাজীবী

পান বাংলার গ্রামীণ সমাজে একটি আদরনীয়—আকর্ষণীয় ও সম্মানের বস্তু। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পান উৎপাদন হয়ে আসছে। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে পান চাষ হয়ে আসছে। পান বাংলার মানুষের কাছে সমাদৃত। যারা পান চাষ করে তারা বারুই হিসেবে পরিচিত। বারুই আর্য সমাজের বর্ণের ও পেশার একটি সম্প্রদায়।

পান খাওয়া বাংলাদেশের জনগণের একটা প্রাচীন অভ্যাস। খাওয়া-দাওয়া শেষে একটা পান ছিল সবার কাছে আকর্ষণীয়। সামাজিক অনুষ্ঠানে পানের প্রয়োজন ছিল। পান আমন্ত্রণ ও অতিথি অভ্যাগতদের সম্মানার্থে প্রদান করা হতো। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম পাদে বাংলায় ভ্রমণকারী চৈনিক দূতগণ এদেশের জনসাধারণের মধ্যে পান খাওয়ার অভ্যাস দেখতে পান।

 

বারুই বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

‘বাহরিস্তান-ই-গায়েবী’ গ্রন্থে অতিথি-অভ্যাগতদের আগমণ প্রত্যাগমণে পান প্রদানে আপ্যায়ন করার রীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। দৌলত খান লোদী কাবুলে বাবরের নিকট ভারতে তাঁকে আমন্ত্রণ দেন এবং সমর্থনের অঙ্গীকারস্বরূপ পান উপঢৌকন হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।

বাংলাদেশের আবহাওয়া পান চাষের উপযোগী। বাংলাদেশের যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, কক্সবাজার প্রভৃতি জেলায় পান চাষ হয়ে থাকে। কাজেই এ সমস্ত জেলাগুলোতে বারুই সম্প্রদায়ের লোকেরা পান চাষে নিয়োজিত রয়েছে। সাত/আট কাঠা জমিতে পান চাষ করে এক হাজার থেকে বারশ টাকা খরচ হয়। পান চাষের প্রয়োজীয় সামগ্রীর দামও বেড়ে গেছে।

পান চাষী বাঁশ, বাঁশের মাচান, সুতলি, খড় ইত্যাদি ব্যবহার করে। পান চাষীরা মহাজনদের কাছে পান বিক্রি করে থাকে। বাংলাদেশের প্রতি হাটে- বাজারে, শহরে-বন্দরে-গঞ্জে পান বিক্রেতাদের দেখা যায়। পান বিদেশেও রপ্তানি হয়ে আসছে। পান চাষে প্রচুর পরিশ্রম হয়। পান চাষে খরচও বেশি। সেজন্য পান চাষী বা বারুই সম্প্রদায় পান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

বারুই সম্প্রদায়ের কাজ পান চাষ করা। উৎপাদিত পান বিক্রি করে এরা জীবিকা নির্বাহ করে। কালকেতুর গুজরাটে বারুই বসতি স্থাপনের পর নিত্যদিন মহাবীরের নিকট পান পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী—

বারুই নিবাসে পুরে বোরজ নির্মাণ করে,মহাবীরে নিত্যদেই পান ।

মরে যাচ্ছে টাকার গাছ। সংকুচিত হচ্ছে টাকার গাছের আবাদ। পানপাতাকে রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ টাকার গাছ হিসাবে অভিহিত করে থাকে। পান গাছের পাতা ছিঁড়লেই টাকা পাওয়া যায় বলে পানকে বলা হয় টাকার গাছ।

দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল পান চাষ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। পানের বরজের সংখ্যা দিন দিন কমছে। পানের বরজের স্থলে চাষ হচ্ছে পেঁপে কিংবা বেগুনের। নানা সমস্যার মুখে পড়ে পানচাষীরা ঝুঁকে পড়েছে অন্য আবাদের দিকে।

দেশের আনাচে-কানাচে আর কিছু না হোক একটা পানের ঢোপ চোখে পড়বেই। পানের লাখো খিলি বেচে জীবিকা নির্বাহ করে লাখো মানুষ। এতে বুঝা যায়, পান ভোক্তার সংখ্যা। পানের কদর শুধু আমাদের দেশে নয়। দেশের বাইরেও রয়েছে এর প্রচুর কদর। পান রপ্তানি করে বছরে শত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব এমন কথা কৃষি বিশেষজ্ঞদের।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বিদেশেও পানের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও উৎপাদন ঘাটতির জন্য রপ্তানী সম্ভব হচ্ছে না। আর এই উৎপাদন বৃদ্ধির কোন উদ্যোগও চোখে পড়ে না। দেশে সাধারণত ৪ ধরনের পান উৎপন্ন হয়ে থাকে। এগুলো হলো : পিঠা পান, সাচি পান, মজুন পান ও খাসিয়া পান। এর মধ্যে সাচি পান ও মিঠা পান বেশী জন্মে রাজশাহী অঞ্চলে। অন্যগুলো চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

রাজশাহী জেলার ৯ থানার মধ্যে ৭ থানা এলাকায় পানের চাষ হয়। এখানে দেড় হাজার হেক্টর জমির ওপর ২৩ হাজারেরও বেশি পানের বরজ রয়েছে। গড় বার্ষিক উৎপাদন ২৫ হাজার মেট্রিক টন। পান চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ২০ হাজারের বেশি কৃষক। পাবনার ঈশ্বরদী, সাঁথিয়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা এলাকায় পানের আবাদ হয়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী, মহেশখালী, কক্সবাজার এলাকায় মিষ্টি পান জন্মে থাকে।

পাহাড়ী এলাকায় হয় খাসিয়া পান। এছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানেও কিছু কিছু পানের আবাদ হয়। রাজশাহীর সবচেয়ে বেশি পান উৎপাদন হয় মোহনপুর উপজেলায়। এ উপজেলার বৈরিশা, ধুরইল, বাক শিমুল, কৃষ্ণপুর, জাহানাবাদ, সইপাড়া, মৌপাড়া ইত্যাদি এলাকা ঘুরে পান চাষীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, পানের আবাদ দিন দিন কমছে। নানা কারণে পানের বরজের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

কয়েক বছর আগে পান বরজে হানা দেয় গোড়া পচা রোগ। এতে বরজের পর বরজ উজাড় হয়ে যায়। এ রোগে প্রথমে গাছের গোড়া পচে যায়। এরপর ধীরে ধীরে গাছ মরে যায়। এই গোড়া পঁচা রোগে পানের বরজ উজাড় হলেও কৃষি বিভাগ কোন পদক্ষেপ নেয়নি বলে কৃষকদের অভিযোগ। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মতে, পান বরজে কাঁচা খৈল ব্যবহারে এই গোড়া পচা বা ছত্রাক রোগ দেখা দেয়।

পান চাষীদের কাঁচা খৈল ব্যবহারের জন্য নিষেধ করলেও তারা তা মানতে নারাজ। কৃষকদের বক্তব্য হলো, যুগ যুগ ধরে তারা খৈল ব্যবহার করে আসছে। এখনও সেভাবে করছে। খৈল ব্যবহার ছাড়া পানের আবাদ সম্ভব নয়। তাছাড়া এত বছর রোগ হলো না, এখন কেন ? তাদের ধারণা অন্য কোন কারণে এ রোগ হয়েছে।

মোহনপুর, তানোর, বাগমারা, দুর্গাপুর এলাকা সরেজমিনে দেখার সময় জানা যায়, পানের বরজের স্থলে এখন বেগুন বা অন্য ফসলের আবাদ হচ্ছে। রোগবালাই ছাড়াও পান চাষে খরচ বেড়েছে। বরজ তৈরির উপকরণ বাঁশ, পাটখড়ি, শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অথচ পানচাষীরা পানের দাম পায় না। পচনশীল বলে ধরেও রাখতে পারে না।

এমনি নানা সমস্যায় পড়ে পান চাষ ছেড়ে দিচ্ছে তারা। যাদের ১০/১২টি পানের বরজ ছিল, তাদের এখন রয়েছে ২/১টি করে। কেউ কেউ ধরে রেখেছে পুরানো পেশা হিসাবে। পান চাষ হয়ে পড়েছে সংকুচিত। পবার পানচাষী আগে পানগাছকে টাকার গাছ বলে মনে করতে।

পান পাতা ছিড়লেই টাকা পাওয়া যেত বলে। আগে পান বরজ তৈরি খরচ কম ছিল। একবার করলে অন্তত ১০/১২ বছর স্থায়ী হতো। পানের দামও পাওয়া যেত। এখন আর সে অবস্থা নেই। তাই পান চাষীদের উৎসাহ হারিয়ে গেছে। পান বরজ দেখার সময় লক্ষ্য করা যায়, চাষীরা তাদের ইচ্ছেমত আবাদ করছে। ব্যবহার করছে নানারকম কীটনাশক।

ভাল আবাদের আশায় কীটনাশক ব্যবসায়ীদের প্রচার-প্রচারণায় পড়ে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করছে। একশ্রেণীর পান চাষী তাদের বরজের পান সবুজ ও মচমচে রাখার জন্য ‘ডাইমেক্রন’ নামে এক ধরনের বিষ পান পাতায় স্প্রে করছেন।

 

বারুই বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

চৈনিক দূতগণ বাংলাদেশে পান খাওয়ার প্রথা সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ পান-সুপারি দিয়ে মেহমানকে আপ্যায়ন করাতো। মেহমানকে পান দিয়ে আপ্যায়ন করা হলে তাকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হতো বলে মনে করা হয়। ভারতীয় সমাজে পানের মর্যাদার কথা উল্লেখ করে ‘মাসালিক আল আবসার’ গ্রন্থের রচয়িতা লিখেছেন “এই দেশের লোকেরা এর চেয়ে (পান) অধিক সম্মানের বিষয় অন্য কিছু মনে করে না।

কোনো অতিথিকে গৃহস্বামী সমস্ত রকম উপাদেয় খাদ্য, কাবাব, মিষ্টান্ন, পানীয় দ্রব্য, সুগন্ধিও সুবাসিত দ্রব্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করালেও যদি শেষে পান দ্বারা আপ্যায়ন না করে, তবে এটা তাকে সম্মান করা হয়নি মনে করা হতো। একইভাবে কোন উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করতে ইচ্ছা করলে তিনি তাকে ‘পান’ প্রদান করতো।

এ সমস্ত বর্ণনা থেকে দেখা যায় প্রাচীন বাংলাদেশের গোষ্ঠী পানের ব্যবহার করতো প্রচুর এবং সে কারণে এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানের উৎপাদনকারী বারুই সম্প্রদায়ও ছিল। অস্বচ্ছলতা, আবহাওয়ার বিরূপতা এবং উৎপাদন খরচ অত্যধিক হওয়ায় বারুই সম্প্রদায় সীমিত হয়ে আসছে। বারুইরা এখন অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment