আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় সংযোগ স্থাপন ও ক্যারিয়ার
সংযোগ স্থাপন ও ক্যারিয়ার
সংযোগ স্থাপন ও ক্যারিয়ার
যোগাযোগ স্থাপন বলতে প্রথমেই আমাদের চিন্তায় কী আসে একবার ভেবে দেখ তো। দুটো জিনিসকে সংযুক্ত করা কিংবা একাধিক বস্তুকে একসাথে যুক্ত করা, তাই না? ইলেকট্রনিকস হলে বৈদ্যুতিক তার দিয়ে যুক্ত করা যেতে পারে, অন্য কোনো বস্তু হলে অন্য কোনোভাবে । কিন্তু একাধিক ব্যক্তিকে কি একসাথে যুক্ত করা যায়? তাহলে তোমরা অন্যের সাথে সংযোগ স্থাপন করবে কীভাবে?
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে সকল মানুষ পাশাপাশি একত্রে বসবাস করে। এই মানুষেরা কি পরস্পরের সাথে যুক্ত? এমন কী হতে পারে যে, সমাজের সকল মানুষ আসলে অদৃশ্য কোনো বন্ধনে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত? আমরা কি জানি- সেই অদৃশ্য বন্ধন কী?
মানুষ হিসেবে আমরা একে অন্যকে যেমন শ্রদ্ধা করি, তেমনি দল-মত নির্বিশেষে একসাথে মিলেমিশে বসবাস করতে চাই । পৃথিবীর সকল মানুষ আসলে মায়ার অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ । পরিচিতজনদের প্রতি আমাদের এই মায়ার পরিমাণটা অনেক বেশি। আমরা আমাদের পরিচিতজনদের কাছাকাছি থাকতে চাই, সবসময় তাদের মঙ্গল কামনা করি।
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, শুধু সামাজিক জীবনেই নয়, কর্মক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার বিদ্যমান। কর্মক্ষেত্রে সকলেই একটি অদৃশ্য বন্ধনে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে । কর্মক্ষেত্রের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হলে অনেক কিছু জানতে হবে, শিখতে হবে। সেসব শুধু বই পড়ে শেখা যায় না । বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা প্রয়োজন।
তাছাড়া, কর্মক্ষেত্রের বিশাল এক জগৎ থেকে নিজের পছন্দের কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে হলে চাই একে অপরের সাথে জানাশোনা ও বড়দের পথনির্দেশ ।
এসো আমরা কয়েকজন মানুষের জীবনের ঘটনা শুনি:
কেস স্টাডি ১ : আশিস রঞ্জন দে কুমিল্লায় বাস করেন । তিনি ছোটবেলা থেকেই নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে খুব পছন্দ করতেন । যেখানে যার সাথেই তার দেখা হতো, তিনি তাদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতেন । তাদের সাথে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। পড়াশোনা শেষ করার পর আশিস রঞ্জন দে একটি চাকরি পেলেন। কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল, তিনি নিজের মতো করে একটা ব্যবসায় দাঁড় করাবেন ।
কী ব্যবসায় করলে ভালো হয়- তা নিয়ে তিনি পরিচিত মানুষের সাথে কথা বললেন । তার পূর্ব- পরিচিত ঢাকায় একজন নামকরা ব্যবসায়ীর কাছেও আশিস উপদেশ চাইলেন। সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক আশিসকে বললেন, ‘ঢাকায় টাটকা সবজি পাওয়া খুব কঠিন। ঢাকার বড় বড় ডিপার্টমেন্টল স্টোরে সবজির নিয়মিত জোগান দিতে পারলে খুবই ভালো হয়।’ এই ব্যবসায় ভাবনাটা আশিসের ভালো লাগল ।
তিনি খোঁজ করে দেখলেন, ঢাকায় তার পরিচিত বেশ কয়েকজনের এ ধরনের ব্যবসায় রয়েছে। আশিস তাদের সাথে যোগাযোগ করে কোন ধরনের সবজি তাদের প্রয়োজন, কেমন দাম তারা দিতে পারবেন এবং কী পরিমাণ চাহিদা ইত্যাদি জেনে নিলেন। তারপর, এলাকার কয়েকজন সবজি চাষির সাথে কথা বললেন। সবজি চাষিরা তাকে জানাল, সব সময় তারা ভালো দাম পায় না ।
আবার, অনেক সময় যখন সবজি বিক্রির সময় আসে তখন ক্রেতা না পাওয়ার কারণে সবজি নষ্ট হয়ে যায় । আশিস একটা ট্রাক ভাড়া নিয়ে সবজি ক্ষেত থেকে টাটকা সবজি সংগ্রহ করে ঢাকায় সবজির জোগান দেওয়া শুরু করলেন। সবাই খুব খুশি হলো। কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্য দাম পেল। ঢাকার বড় বড় দোকানের মালিকরা ক্রেতাদের নিকট ভালো সবজি বিক্রি করতে পেরে খুশি। সবাই আশিসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল । আর তার ব্যবসায়ও ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল ।

কেস স্টাডি ২ : চাঁদপুরের ছোট্ট একটি গ্রামে জান্নাতুল ফেরদৌস বাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে নিজের গ্রামেই একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন গড়ে তোলেন। এ সংস্থার মাধ্যমে তিনি এলাকার মানুষকে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন । শিক্ষাজীবনে তাকে শিক্ষকেরা প্রায় বলতেন জীবনে উন্নয়নের জন্য সব সময় সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে । এ কথা তিনি প্রায়ই মনে করেন । তাই তার পরিচিত সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের সুযোগ পান । তিনি এখানে যাদের সঙ্গে পরিচিত হন তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন । তিনি সব সময় তার এলাকার বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, শিশুদের ডায়রিয়া ও পানি বাহিত রোগের প্রকোপ, এগুলো নিয়ে ভাবতেন আর কীভাবে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় তার পথ খুঁজতেন।
ঢাকার একটি সেমিনারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে তার পরিচয় ঘটে। এ পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। একদিন ঐ কর্মকর্তা জানালেন জান্নাতুলের সংস্থার মাধ্যমে তার এলাকার সমস্যা সমাধানে তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন । পরবর্তী সময়ে জান্নাতুল তার এলাকার সমস্যা সমাধানে সক্ষম হলেন। উল্লিখিত দুজন মানুষের জীবনের গল্প থেকে আমরা কী শিখলাম?
সম্পর্ক স্থাপন মানে চারপাশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া। তবে শুধু পরিচিত হলেই হবে না। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে । কাজেই, সম্পর্ক স্থাপন হলো কারও সাথে পরিচিত হয়ে তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা । আশিস ও জান্নাতুল ফেরদৌসের জীবনের গল্প থেকে আমরা জেনেছি যে, তাদের কর্মক্ষেত্রে সফল হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন । সম্পর্ক স্থাপন অনেক রকম হতে পারে । যেমন-
- ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন (যেমন আমাদের সহপাঠীদের সাথে আমরা ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করে থাকি; তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলি । বিপদে-আপদে একে অন্যের পাশে দাঁড়াই) ।
- পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন (পেশাগত প্রয়োজনে, আমাদের অনেকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। পেশাগত জীবনে সহকর্মীসহ অনেকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়)।
- সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন (একই সমাজে আমরা যারা বসবাস করি, তারা পরস্পরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকি)।
এছাড়াও সম্পর্ক স্থাপন আরও অনেক রকম হতে পারে। তবে যেখানে যেমনই হোক না কেন, সম্পর্ক স্থাপন মানেই হলো যোগাযোগ স্থাপন এবং তা নিয়মিত রক্ষা করে চলা। নিয়মিত যোগাযোগ না থাকলে স্থাপিত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ।
সম্পর্ক স্থাপন যে শুধু ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির হয় তা কিন্তু নয় । অনেক প্রতিষ্ঠান বা সংঘের সাথেও সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে । যেমন বাংলাদেশ জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে । তবে, এখানে আমরা শুধু ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়েই শিখব ।
আরও দেখুন :