কাঁসারু বাংলাদেশের পেশাজীবী

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কাঁসারু বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।

কাঁসারু বাংলাদেশের পেশাজীবী

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় কাঁসা-পিতলের ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেন রাজাদের শাসনামলে এদেশে ধাতু সংমিশ্রণ শিল্পের সূচনা হয় বলে কথিত আছে। ভাল কারিগর হিসেবে ঢাকার কাসারু ও তাম্রকারগণের বিশেষ খ্যাতি আছে। জেমস টেলরের ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ গ্রন্থে ঢাকা ও বিক্রমপুরের কাঁসারুদের বর্ণনা পাওয়া যায়। আর্যদের বর্ণ বিভাজনের উপবর্ণে কংসকারের অস্তিত্ব রয়েছে।

 

কাঁসারু বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

কাঁসারু বা কাঁসারি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ভুক্ত। কাঁসারু সম্প্রদায় তামা-পিতল প্রভৃতি কংসজাত ব্যবহার্য দ্রব্যাদির প্রস্তুতকারী ও বিক্রেতা। কাঁসারু সম্প্রদায় পিতল, কাঁসা প্রভৃতি আগুনে গলিয়ে ছাচ অনুযায়ী দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি প্রস্তুত করে থাকে। কবি কঙ্কন মুকুন্দ রচিত ‘চন্ডীমঙ্গল” কাব্যে কাঁসারুদের উল্লেখ পাওয়া যায়। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কাসারুদের পরিচয় এভাবে পাওয়া যায়।

কাঁসারি পাতি আশাল ঝারি খুরি গড়ে খাল

বাটী ঘটি বট লই শিপ।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মৃৎশিল্পের পাশাপাশি কাসা শিল্পের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রচলন ঘটেছে। প্রাচীন অস্থাবর সম্পদ হিসেবে কাঁসা শিল্পের কদর ছিল। আগেকার দিনে মানুষ জন্ম-বিবাহ-খাতনা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কাঁসার তৈরি জিনিসপত্র উপহার হিসেবে প্রদান করতো। গ্রামাঞ্চলের কাঁসা ও পিতল শিল্পীরা অত্যন্ত সুনিপুণ কৌশলে কাঁসা-পিতলের নানা দ্রব্যাদি প্রস্তুত করত।

তাদের তৈরিকৃত দ্রব্যাদি হলো কাঁসা-পিতলের থাল, বাটি, কলসি, গ্লাস, বদনা, পঞ্চ প্রদ্বীপদান, মোম বাতিদান, লোটা, কুপি, চামচ, কাজলদানি, ঘটি, জগ, ভাজাকাটা প্রভৃতি। আজকের মানুষ কাঁসা-পিতলের দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন। যদিও এসব দ্রব্যাদি টেকসই এবং সহজে জৌলুস হারায় না।

এককালে এদেশের জমিদার ও ভূস্বামীগণের বড়ই প্রিয়, তৈজসপত্র ছিল এই— কাঁসা-পিতলের সামগ্রী। তাদের আনুকূল্যে কাঁসা-পিতলের দ্রব্যাদি নির্মাণ কারিগর সমাজে নিত্যনতুন জিনিসপত্র তৈরি করেছে প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্য।

জমিদারগণও ছিলেন বৈচিত্র্যের প্রয়াসী। তাঁরাও চাইতেন নানা কারুকাজ খচিত কাঁসার বাসনপত্র। একসময় মানুষ কথা বলার মাঝে পিতলের কলসীর বিভিন্ন উপমা ও প্রবাদবাক্য ব্যবহার করতো।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

প্রাচীনকালে তামা-কাসা শিল্পের ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে বগুড়ার মহাস্থান গড়ের বসুবিহার থেকে প্রাপ্ত বৌদ্ধ দেব-দেবীর মূর্তি। এ-শিল্প বাংলাদেশে পাল শাসনামলের নিদর্শন। এদেশে কাসা পিতলের ব্যবহার অনেক কাল থেকেই জনপ্রিয় ও গৌরবের। কাঁসা- পিতলের ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ও তৈজসপত্র কয়েকটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা হয়।

প্রথমত- ছাঁচে ঢেলে দ্রব্যাদি তৈরি করে সেটির উপর বিভিন্ন নক্সা খোদাই করা হয়। দ্বিতীয়ত- পুরানো ধাতু গলিয়ে তা’ মাটির ছাঁচে ঢেলে ঠাণ্ডা হলে ছাঁচটি ভেঙ্গে তৈজসটির পৃথক করা এবং ইস্পাতের কলম দিয়ে উক্ত তৈজসটির উপর বিভিন্ন কারু কাজ করা। প্রাচীনকালে গ্রামীণ জীবনে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ছিল দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য।

প্রাচীনকালে কাসা-পিতলের তৈজসপত্রে লোকবিশ্বাস ও লোকধর্মসম্পৃক্ত বিভিন্ন কারুকাজ খোদাই করা হতো। ব্রিটিশ শাসনামলে কাসা পিতল দিয়ে কোষাকোষী, পঞ্চপ্রদীপ, নন্দীপ্রদীপ প্রভৃতি পূজাপার্বণে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি বানানো হতো। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষ করে ফরিদপুর ময়মনসিংহ, ধামরাই, জামালপুর, নবাবগঞ্জ এ সমস্ত অঞ্চলের কাঁসা-পিতলের অলঙ্কৃত তৈজপত্র, মূর্তি ও পুতুল বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ ছিল।

কাসা-পিতলের তৈরি ড্রেসিং টেবিলের সন্ধান পাওয়া যায়। ঊনিশ শতকের চতুর্থ দশক পর্যন্ত অভিজাত মুসলিম মহিলাগণ এ ধরনের ড্রেডিং টেবিল প্রতিদিনের রূপসজ্জার জন্য ব্যবহার করতেন। সেকালে কাঁসারুরা ছোট ছোট বাক্সপেটা, হুকাদণ্ড, আগরদানি, চিলুমচি, পিকদানি, পানের বাট্টা ইত্যাদি তৈরি করতো।

 

কাঁসারু বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

আগেকার দিনে স্বচ্ছল পরিবারে কাসা- পিতলের থালা, ডাবর, বাটি, বদনা, গাড়ু, ঘটি, খুন্তি, ঘড়া, কলস, ডেগ প্রভৃতি জিনিস ব্যবহার করা হতো। কাঁসারুরা এ সমস্ত জিনিসপত্রের গায়ে বিভিন্ন ধরনের নকশা এবং কারুকার্য করতো। এ কারুকার্য থেকে সেকালের কাসারুদের শিল্প নিপুণতার পরিচয় পাওয়া যায়। সেকালে গ্রামে, গঞ্জে, নগরে, হাটে, বাজারে সবখানেই এদের পদচারণা ছিল।

মাথায় অথবা বাকের সাহায্যে ঝুড়িতে কাঁধে করে এরা গ্রামে গ্রামে এসব বিক্রির জন্য ঘুরতো। হাটে, বাজারে, বন্দরে, গঞ্জে, মফস্বল শহরে কাসারুদের দোকান আছে। বাংলাদেশের ঢাকা, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় এদের বেশি দেখা যায়। কাঁসারুরা হাতুড়ি, চামড়ার হাপর, ছাচ, কাঠ-কয়লা প্রভৃতি জিনিস ব্যবহার করে।

বর্তমানে এনামেল, প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন ইত্যাদি শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ফলে কাঁসা- পিতলের তৈরি জিনিসের ব্যবহার অনেকাংশে কমে গেছে। গ্রাম বাংলায় কাঁসা-পিতলের ব্যবহার একদম হারিয়ে যায়নি। তবে আধুনিকতার প্রভাবে কাঁসারুদের বর্তমান দুর্দিন যাচ্ছে।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment