আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কৃষিজীবী বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।
কৃষিজীবী বাংলাদেশের পেশাজীবী
আদিম যুগের মানুষেরা বনে-জঙ্গলে বাস করতো। বনজঙ্গল থেকে ফলমূল সংগ্রহ করে খেতো। পশু-পাখি, জীব-জন্তু শিকার করে তার মাংস খেতো। সে সময় তারা যাযাবর জীবন যাপন করতো। মানুষ সংগৃহীত শস্য ও ফলমূল খেয়ে তার বীজ আশেপাশে ফেলে দিত। ফলের বীজ ও শস্যকণা থেকে গাছ জন্মাতো। গাছ থেকে ফল-শস্য পাওয়া যেতো।
এ থেকে আদিম মানুষের মাঝে কৃষিকাজের ধারণা জন্ম নিল। আদিম মানুষের চোখা পাথর এবং গাছের সূচাল ডাল দিয়ে মাটি খুড়ে কৃষি কাজের সূচনা করে। কৃষি কাজ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলেই প্রথম শুরু হয়। নদী বিধৌত পানির পলিমাটি পতিত জমি চাষবাসের জন্য বিশেষ উপযোগী। বাংলাদেশে রয়েছে প্রচুর পালিবিধৌত সমতল ভূমি, যা চাষবাসের জন্য অত্যন্ত ভাল।
বাংলার উর্বর মাটি কৃষিকাজের বিশেষ উপযোগী। অতি অল্প পরিশ্রমেই এখানে অনেক বেশি ফসল উৎপন্ন করা যায়। প্রাচীন বাংলায় অস্ট্রিকদের সময় থেকেই কৃষির প্রচলন ছিল। ‘লাঙ্গল’, ‘কার্পাস’ অস্ট্রিক শব্দ। কাজেই অনুমান করা যায় অস্ট্রিক আমলে এদেশে কৃষি ব্যবস্থার প্রচলন ছিল।
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশে আটষট্টি হাজার গ্রাম রয়েছে। গ্রামে বাস করে শতকরা পঁচাশিভাগ মানুষ। গ্রামবাসীর অধিকাংশই কৃষক। কৃষি কাজই গ্রামবাসীর প্রধান জীবিকা। যারা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে তারাই কৃষক।
আগে কৃষকদের জমির উপর কোনো মালিকানা ছিল না। জমি ছিল সরকারের বা জমিদারদের। বাংলায় জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর এদেশের কৃষকেরা জমিতে তাদের নিজস্ব মালিকা পায়। এর আগে কৃষকদের সাথে জমিদার-ভূস্বামীদের সম্পর্ক ছিল প্রজা বা রায়ত। বাংলার কৃষকরা অশিক্ষিত।
প্রাচীনকালে বাংলার কৃষকের আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল। তখন বাংলার কৃষকের গোলাভরা ধান ছিল, গোয়াল ভরা গরু ছিল, পুকুর ভরা মাছ ছিল। বাংলার কৃষকের চাহিদা নিতান্ত কম। হালের বলদ, মোটা ভাত, মোটা কাপড় আর মাথা গুজার ঠাঁই পেলেই সে সন্তুষ্ট। বাংলার কৃষক সম্পর্কে কবি লিখেছেন—
ভোর না হতে লাঙ্গল কাঁধে মাঠ পানে কে যায় ?
সে আমাদের কৃষক, বলি বাস উহাদের গাঁয়।
মোটা কাপড় পরে ওরা খায় যে মোটা ভাত,
কষ্ট করে কোনো মতে কাটায় দিনরাত।

আগেকার দিনে মহাজনদের ঋণের বোঝা আর জমিদারদের খাজনা পরিশোধ করতে না পারায় কৃষকদের উপর নেমে আসতো অমানুষিক অত্যাচার। কৃষকদের জিনিসপত্র ক্রোক করা হতো। ভিটেমাটি নিলাম করা হতো। ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারে আর নীল চাষে বাধ্য করাতে অনেক কৃষক ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম ছেড়ে কৃষকেরা পালিয়েছে। বাংলার কৃষকের বর্তমান অবস্থাও ভাল না।
এখনও প্রকৃতির ওপর কৃষকদের নির্ভর করতে হয়। কৃষক সেই লাঙ্গল, বলদ, মই আর নিড়ানি দিয়েই কৃষি কাজ করছে। আধুনিক উন্নতমানের বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষকের কাছে দুষ্প্রাপ্য। ট্রাক্টর, আধুনিক ধানমাড়াই কল, ধান-গম কাটা কল, সেচযন্ত্র কৃষকের হাতে পৌঁছায়নি। কৃষক এখনও রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে না খেয়ে জমিতে কাজ করে।
অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, কীটপতঙ্গের আক্রমণে কৃষকের ফসল নষ্ট হয় বাংলার কৃষক বিভিন্ন শ্রেণীর বা পর্যায়ের। ভূস্বামী কৃষক, মধ্যবিত্ত কৃষক. নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক, বর্গাচাষী, ভূমিহীন কৃষক।
কৃষি উৎপাদন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, ঋণের বোঝা মধ্যবিত্ত কৃষক ও ভূমিহীন কৃষককে ধীরে ধীরে দিনমজুর বা ক্ষেতমজুরে পরিণত করেছে। ঋণের বোঝায় কৃষক তার জমিজমা, ভিটেমাটি হারিয়ে জীবন ও জীবিকার আশায় শহরের দিকে পা বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশে বর্তমান আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৩,৩৪,৭৭,৫৩২ একর। জমির পরিমাণ ২,৪২,৫৮,৮০০ একর। অধিক জনসংখ্যার চাপে এবং নতুন নগরায়ণের এবং শিল্পকারখানা স্থাপনের ফলে আবাদী জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে।
কৃষক ধান, পাট, আখ, তুলা, গম, তৈলবীজ, ভুট্টা, যব, মুসুরি, খেসারি, ছোলা ইত্যাদি ফসল ফলিয়ে থাকে। কৃষক শাক— সবজি, পিঁয়াজ-রসুন, আলু এগুলোও উৎপাদন করে। কৃষক কৃষিকাজে লাঙ্গল, জোয়াল, মই, ইশ, কাচি, নিড়ানি, আচড়া, মাথাল, হুকা, কলকে, রেনা প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকে। বাংলার কৃষকের এখন আর গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ নেই। জীর্ণ বস্ত্র, শীর্ণ দেহই বাংলার কৃষকের প্রতীক।
আরও দেখুনঃ