আগ্রহ ও মনোযোগ এবং ক্যারিয়ার গঠনে আগ্রহ ও মনোযোগের গুরুত্ব আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বাউবি এসএসসি ২৩৫৮ ক্যারিয়ার শিক্ষা” এর “ক্যারিয়ার গঠনের উপাদান ও কৌশল” ইউনিট ২ এর অন্তর্ভুক্ত।
Table of Contents
আগ্রহ ও মনোযোগ এবং ক্যারিয়ার গঠনে আগ্রহ ও মনোযোগের গুরুত্ব
আমরা দেখেছি একজন ক্যারিয়ারসম্পন্ন ব্যক্তির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল তিনি নিরলস পরিশ্রম করতে পারেন। অন্যান্য অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কাজের প্রতি অনুরাগ এবং ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতে পারা তার একটি বৈশিষ্ট্য। কিন্তু একজন মানুষের কাজের প্রতি অনুরাগ তখনই জন্মে যখন সে কাজটি করতে ভালবাসে বা আনন্দ পায়। অর্থাৎ কাজটির প্রতি সে আগ্রহী হয়। কাজটি যদি তার নিজের বা অপরের কোন প্রয়োজন মেটাতে পারে বা কাজটি করে দেশ ও দশের কোন উপকার হয় তবে সে কাজটি করতে তার আগ্রহ জন্মাবে। অন্য কথায় বলা যায়, যে কাজের চাহিদা আছে মানুষ সে কাজ করতে আগ্রহী হয়।
আগ্রহ থাকলে সে কাজটি এমনভাবে করবে যেন কাজটি শতকরা একশ ভাগ ফলপ্রসূ হয়। এর জন্য চাই মনোযোগ। সে যদি নিরবিচ্ছিন্ন মনোযোগ দিয়ে কাজটি করে তবে তার ফলাফল হবে পরিপূর্ণ। দেখা যায়, কোন কাজে ব্যক্তির আগ্রহ থাকলে স্বাভাবিকভাবে সে সেটি করতে পূর্ণ মনোযোগ দেয়। মানসিক শারীরিক বা কোন পরিবেশগত কারণে যদি সে অখণ্ড মনোযোগ নাও দিতে পারে তবে সে তার সম্পূর্ণ ইচ্ছা কাজে লাগিয়ে কাজটি সম্পন্ন করে। সুতরাং কাজের প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ কাজকে সুচারুরূপে সমাধান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মনোযোগ দিয়ে কাজ করে ব্যক্তি সার্থকতার চরম শিখরে পৌঁছতে পারে।
কাজ – এক
আপনার আগ্রহ আছে এমন পাঁচটি বিষয়ের নাম লিখুন। যেমন, সঙ্গীত, জনসেবামূলক কোন কাজ ইত্যাদি। প্রতিটি বিষয়ে কেন আপনার আগ্রহ জন্মেছে বিস্তারিত লিখুন।
আগ্রহ
আগ্রহ হল কোন বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়ার জন্য এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতি এমনি এমনি হয় না। এর জন্য মানুষের ভিতর থেকে তাগিদ থাকতে হয়। এখানে যে বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে তাকে উদ্দীপক বলা যায়। যেমন, পাটিগণিত বা বীজগণিতের অংক বা জ্যামিতি। সাধারণত কোন শিক্ষার্থীর শিখনের জন্য আগ্রহ তৈরি করতে হয়। অংকের ক্ষেত্রে যদি আগ্রহ তৈরি করতে হয় তবে তার জন্য শিক্ষার্থীর মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়ার জন্য প্রথমে শিক্ষার্থী তার ভিতর থেকে অংক করার তাগিদ বা প্রয়োজন অনুভব করে । এজন্য সে অংক করার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে, অর্থাৎ আগ্রহী হয়।
আগ্রহকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। হার্বার্ট এর মতে, আগ্রহ হলো নতুন কোন জ্ঞান আহরণের জন্য মনের প্রস্তুতি আবার ডিউইর মতে আগ্রহ হলো, ব্যক্তির নিজের বিকাশ প্রক্রিয়া অভিমুখে তার স্বতঃস্ফূর্ত অগ্রগতি। যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন আপনার কাছে নিশ্চয়ই এটি স্পষ্ট হয়েছে যে কোন উদ্দীপকের প্রতি আগ্রহী হতে হলে মনকে
বিশেষভাবে তৈরি বা সংগঠিত করতে হয়। এই সংগঠনের নাম হল মানসিক প্রস্তুতি। যেমন, কোন কোন মানুষ আছে যারা রান্নার প্রতি বিশেষ আগ্রহী। অর্থাৎ রান্না কৌশল বা প্রক্রিয়াটি একটি উদ্দীপক এবং এই উদ্দীপকের প্রতি মনোযোগ দেয়ার জন্য তারা নিজেদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন। এর জন্য তারা যে প্রয়োজন বা তাগিদ অনুভব করেন তা হল উৎকৃষ্ট মানের খাওয়া ।
মানুষের বিভিন্ন ধরনের চাহিদার কারণে সে নিজের ভিতরে প্রয়োজন বা তাগিদ অনুভব করে। যেমন, ‘উৎকৃষ্ট মানের খাওয়া’ একটি জৈবিক চাহিদা। এরকম অন্যান্য চাহিদা হল মানসিক চাহিদা, সামাজিক চাহিদা, কৌতুহলজনিত চাহিদা, সাংস্কৃতিক চাহিদা ইত্যাদি। যে চাহিদার কারণেই আগ্রহ জন্মাক না কেন, এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আগ্রহ মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
মনোযোগ
মনোযোগ হল আগ্রহের পরবর্তী ধাপ। কোন উদ্দীপকের প্রতি যদি আগ্রহ থাকে তবে মানুষ তাতে মনোযোগ দেয়। মনোযোগ একটি মানসিক প্রক্রিয়া বিশেষ। আমাদের চতুর্দিকে বহু রকম উদ্দীপক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এইসব উদ্দীপকের বৈশিষ্ট্য হল এরা প্রত্যেকে তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দ্বারা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমরা হয়তো বিভিন্ন সময়ে সকলের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি, কিন্তু যদি সাড়া দিতে হয় তবে একটির প্রতি সাড়া দিতে হবে। কারণ একসাথে অনেকের প্রতি সাড়া দেয়া কখনও সম্ভব না। সুতরাং মানুষ একটি উদ্দীপককে নির্বাচন করে এবং তার প্রতি সাড়া দেয়।
এই নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সাড়া দেয়াকে একসাথে মনোযোগ বলে। যেমন, মনে করুন আপনি আপনার ঘরে বসে আছেন। ঘরের মধ্যে বিভিন্ন বস্তু যেমন চেয়ার, টেবিল, আলো, ফ্যান, আলমারী, শিশুর কান্না, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা শব্দ, রান্নার গন্ধ ইত্যাদি সবকিছুই উদ্দীপক। এরা সবাই আপনার মনকে আকর্ষণ করছে। কিন্তু আপনি শিশুর কান্নার প্রতি সাড়া দিলেন। অর্থাৎ তার কান্না থামানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন এবং শিশুর প্রতি মনোযোগ দিলেন। এভাবে বহু উদ্দীপকের মাঝে শিশুর কান্না আপনাকে প্রভাবিত করেছে যার জন্য আপনি তার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। অতএব এ কথা বলা যায় যে, মনোযোগ এক ধরনের মানসিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ।
মনোযোগ কিসের দ্বারা নির্ধারিত হয়, এ বিষয়টি শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের চারপাশে বহু উদ্দীপকের মাঝে মাত্র একটি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়, অন্যান্য উদ্দীপক সমর্থ হয় না। এ কারণকে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যায় :
১. অভ্যন্তরীণ নির্ধারক
২. বাহ্যিক নির্ধারক
অভ্যন্তরীণ নির্ধারক
এই ধরনের নির্ধারকগুলো মানুষের মধ্যে থাকে। কোন একটি বিশেষ উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দেয়ার জন্য মানুষের মন তৈরি হয়ে থাকে। অর্থাৎ তার প্রতি সে আগ্রহী আছে। যেমন, একজন সঙ্গীতজ্ঞ গানবাজনার প্রতি মনোযোগী হন। আবার একজন শিক্ষাবিদ লেখাপড়ার বিষয়ে মনোযোগী হন। শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন বিষয় যেমন, সাহিত্য বা বিজ্ঞান শিক্ষার্থী যেটি পড়ে আনন্দ পায় সেটি শেখার জন্য মনোযোগী হয়। এখানে বিষয়টির প্রতি শিক্ষার্থী প্রথমে আগ্রহী হয়, পরে মনোযোগী হয় ।
বাহ্যিক নির্ধারক
এ ধরনের নির্ধারকগুলো উদ্দীপকের মধ্যে থাকে। আমরা উদ্দীপকের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার প্রতি মনোযোগী হয়ে থাকি। যেমন, একটি কাপড়ের(শাড়ী বা জামা) রং দেখে বা তার ডিজাইন দেখে আপনি সেটির প্রতি মনোযোগী হতে পারেন। আবার অনেক খাদ্যের গন্ধ, বর্ণ ও স্বাদ পরখ করে আমরা তার প্রতি মনোযোগী হই ।
আগ্রহ ও মনোযোগের সম্পর্ক
এসএসসি প্রোগ্রাম আগ্রহ ও মনোযোগের মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। মনোযোগ হল মনের উদ্দীপক নির্বাচনী প্রক্রিয়া। এর পিছনে আছে ব্যক্তির মানসিক প্রস্তুতি বা আগ্রহ। আগ্রহ মানুষের মধ্যে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। মানুষ যখন তার আগ্রহের বিষয়টিতে মনোযোগ দেয় তখন তা সক্রিয় হয়ে ওঠে। যেমন, বিজ্ঞান
বিষয়টি পড়ার ইচ্ছা যখন শিক্ষার্থীর মধ্যে কেবল ইচ্ছারূপে থাকে, তখন তাকে আগ্রহ বলা হয়। যখন অনেক বিষয়ের মধ্যে থেকে পড়বে বলে শিক্ষার্থী বিশেষভাবে বিজ্ঞান বিষয়টিকে বেছে নেয় ও পড়ে, তখন সে প্রক্রিয়াকে আমরা মনোযোগ বলি । আগ্রহকে কেন্দ্র করে মনোযোগ সক্রিয় হয়। সুতরাং যা ভিতরে আগ্রহ তা বাইরে মনোযোগ।
ক্যারিয়ার গঠনে আগ্রহ ও মনোযোগের গুরুত্ব
আমরা দেখেছি যে, ব্যক্তির ক্যারিয়ার তার সার্বিক দিক পরিগ্রহ করে গড়ে ওঠে। শুধু সামাজিক দিকই নয়, তার ব্যক্তিগত দিকও ক্যারিয়ার গঠনের অন্যতম উপাদান। ক্যারিয়ার সম্পন্ন একজন ব্যক্তি সমাজে সকলের কাছে সমাদৃত, সকলে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তিনি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। এ কারণে সমাজের বহুবিধ বিষয়ে তার আগ্রহ থাকতে হয়। সমাজে যা কিছু কল্যাণকর, সৃজনশীল, আধুনিক ও ইতিবাচক তার সব বিষয়ে তিনি আগ্রহী থাকবেন এটাই কাম্য।
ক্যারিয়ার গঠনের জন্য ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজকে ফলপ্রসূ করে তুলতে হবে। সেজন্য এসব কাজের প্রতি তার আগ্রহ আছে কিনা তা সর্বাগ্রে দেখতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তাকে তার আগ্রহের উপর নির্ভর করে কাজ নির্বাচন করতে হবে এবং সে কাজে মনোযোগী হয়ে তাতে উৎকর্ষ লাভ করতে হবে। সমাজের মঙ্গলজনক কাজের প্রতি বা কর্মক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কোন কাজের প্রতি নিজেকে আগ্রহী করে তুলতে হলে কাজগুলোকে নিজের পছন্দমতো ও আকর্ষণীয় করে তোলা দরকার।

সে জন্য তিনি নিজেই নিজের কাজের অনুকুল পরিবেশ গঠন করতে পারেন। কাজের প্রতি নিজেকে আগ্রহী করার অন্য আর একটি শর্ত হল কাজের চাহিদা অনুভব করা। সামাজিক তথা সার্বিক উন্নয়নে কাজটি কীরূপ ভূমিকা রাখবে বা তার চাহিদা কতটুকু আছে, ব্যক্তি যদি একবার তা অনুভব করেন তবে তিনি কাজটির গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন এবং আগ্রহী হবেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কাজে আগ্রহ থাকলে সময় ও পরিবেশ অনুযায়ী তিনি অবশ্যই কাজে মনোযোগ দেবেন।
ক্যারিয়ার গঠনে নিজেকে সার্থক করে তুলতে হলে কাজের প্রতি অনুরাগ তৈরি করতে হয়। অর্থাৎ যেহেতু কাজের প্রতি আগ্রহ আছে বা আকর্ষণ আছে, কাজটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। দেখা যায়, কাজে যদি আকর্ষণ থাকে তবে কাজটি যতই কঠিন বা কষ্টদায়ক হোক না কেন ব্যক্তি আনন্দের সাথে তা গ্রহণ করে এবং মনোযোগী হয়। সে কারণে কাজের প্রতি আগ্রহ থাকাই বড় কথা। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহ্যিক, এমনকি অনেকক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কারণের জন্য কাজে স্বত:স্ফূর্ত মনোযোগ আনা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন জোর করে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে হয়।
বস্তুত: এই ইচ্ছাশক্তির পিছনেও কাজ করে ব্যক্তির আগ্রহ। অর্থাৎ কাজটির চাহিদা যদি তিনি অনুভব করেন তবে আগ্রহী হবেন এবং পরিবেশের অভাবে মনোযোগ দিতে না পারলেও প্রবল ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে কাজটি তিনি সম্পন্ন করতে পারেন। ক্যারিয়ার গঠনে ব্যক্তিকে এভাবেই আগ্রহ ও মনোযোগকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হতে হয়।
কাজ – দুই
কাজ এক-এ আগ্রহের বিষয় হিসেবে যেগুলোর নাম লিখেছেন সেগুলোতে কীভাবে মনোযোগ স্থাপন করবেন তা ব্যাখ্যা করুন।
সারসংক্ষেপ
আমাদের চতুর্দিকে অসংখ্য জিনিস বা বিষয় ছড়িয়ে আছে, যার সবকিছুর উপর আমরা প্রতিক্রিয়া করি না বা মনোযোগ দিই না। আমাদের নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী অথবা অভ্যাসবশতঃ আমরা কোন কিছুর উপর মনোযোগ দিই। তবে যে কারণেই আমরা মনোযোগ দিই না কেন মনোযোগের মূলে থাকে বিষয়ের প্রতি আগ্রহ। আগ্রহকে কেন্দ্র করে মনোযোগ সক্রিয় হয়। মনোযোগ দেয়ার জন্য কোন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ থাকা বাঞ্ছনীয়।
এ কারণে যে বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে বা দেয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে আগ্রহ জন্মানোর জন্য বিষয়টিকে মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা দরকার। অর্থাৎ বিষয়টির অবস্থান এমন হবে যে ব্যক্তি তার চাহিদা অনুভব করবে। ব্যক্তি যদি চাহিদা অনুভব করে বা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তবে সে তার প্রতি আগ্রহী হবে। তখন সে ঐ বিষয়সংক্রান্ত কাজ নিজ উদ্যোগে মনোযোগ দিয়ে করবে এবং নিজ জীবন বিকাশে সার্থকভাবে এগিয়ে চলবে। এভাবে ব্যক্তির ক্যারিয়ার গঠনে তার আগ্রহ ও মনোযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
আরও পড়ুন….