‘না’ বলতে শিখুন | ক্যারিয়ার ম্যানেজমেন্ট | শামস্ বিশ্বাস : প্রেসার দু’প্রকার। হাইপ্রেসার ও লো-প্রেসার। দু’টিই শরীরে-মনে ডেকে আনে নানা ঝঞ্ঝাট। বনবন করে মাথা ঘুরে চিৎপটাং হতে সময় লাগে না, আবার অকালে স্বর্গপ্রাপ্তিও ঘটতে পারে। কিন্তু, অফিসে যদি প্রেসার বাড়ে? কাজের প্রেসার তো থাকবেই, কিন্তু ‘অন্য’ প্রেসার!
অফিসে আপনি নতুন। পাকা খেলুড়ে নন। কাজের চাপ, মানিয়ে নেওয়ার চাপ, সিনিয়রদের চাপ, টিকে থাকার চাপ, বছরশেষে ‘ইনক্রিমেন্ট’ না-হলে চাপ সব মিলিয়ে, গাঁড়া কলে। পরিণতি কী? সব ছেড়ে দিয়ে ‘দু’চোখ যে দিকে যায়’ ভাবনা, ‘রেজিগনেশন’ অথবা ‘ফল অফ ডেজিগনেশন’। অসুস্থ হয়ে মেক্যিালে এডমিশন, তাই তো! অত সহজ নয়। চাপের গাছটাকে লকলক করে বাড়তে না-দিয়ে গোড়াতেই উপড়ে ফেলুন। মনে, প্রথম রাতেই বেড়াল মারুন।
দিন দিন বাড়ছে কাজের প্রোস। নানা কারণে বসবাস ‘প্রেসার কুকারে!’ জীবন যতই আধুনিকতার চাদরে মুড়ে যাচ্ছে, হিসাব-কিতাব হয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক! ভোগবিলাসিতা বাড়ছে হু হু করে, আরও পাওয়ার আশায় সকাল থেকে রাত কাজে ডুবে থাকার চেষ্টা করে যেতে হচ্ছে, ততই চাপ বাড়ছেÑমনের ভিতর ও বাহিরে, অন্তরে অন্তরে। সেই চাপ বাড়তে বাড়তে এমন জাযগায় পৌঁছে যাচ্ছে, বড় কোনও রোগ ‘পার্মানেন্ট’ বাসা বেঁধে ফেলছে শরীরে, অকালমৃত্যুও সংবাদও এখান অনেকটা গাসাওয়ার হয়ে যাচ্ছে।
অফিসে চাপ মূলত কাজের ধরন-ধারণ ও কর্মীর দক্ষতার পার্থক্যেও জন্যই হয়ে থাকে। দক্ষতা শুধুমাত্র মানসিক অথবা বুদ্ধিমত্তা নয়, শারীরিক ও আবেগ-দক্ষতাও বটে। কখনও কখনও প্রাথমিক সাময়িক চাপ ছোট ঘটনা বলে উড়িয়ে দিলে সেটাই পরে উড়ে এসে জুড়ে বসে। আর উড়িয়ে নিয়ে যায় জীবন-যৌবন-সজিবতা। তবে, মজার ব্যাপার হল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাপে ভাল কাজ বেরিয়ে আসে। তাই কিছু কিছু কর্মজীবির মুখে শোনা যায়, চাপেই নাকি তাঁরা ভাল কাজ করেন। সেই কথা থাক, আমরা বরং দেখে নিই, অফিসে চাপের কারণগুলি।
অফিসের চাপের কারণ
চাপ নানা প্রকার। উপরচাপ, নিম্নচাপ, পার্শ্বচাপ। ভিন্ন কর্মীÑ স্বাভাবতই চাপের হেরফের। কারণ, একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কর্মী ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেন। সেই ভিন্ন পরিস্থিতিগুলি কী, কাজের জায়গায় যা চাপ তৈরি করে?
অস্বস্তিকর পরিবেশ
কোনও কাখানার কর্মীরা এতে সবথেকে বেশি অসুবিধার মধ্যে পড়েন। মানসিক চাপ তো বটেই, ধীরে ধীরে শরীরও খারাপ হতে থাকে। অফিসেও অস্বস্তিকর পরিবেশ, যেমন ঘিঞ্জি জায়গা, অপরিচ্ছন্নতা, বাতাস খেলতে না-পারা, এ সবই চাপ তৈরি করে কর্মীর উপর।
অর্থনৈতিক কারণ
শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটেছে। ফলে আরও উৎপাদন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। উৎপাদনের লক্ষমাত্রা উত্তরোত্তর বাড়ছে। বিনিয়োগকারীরা কর্তৃপক্ষেও উপর ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে, একদম নিচুস্তর থেকেই যাতে সাফল্য আনা যায়। প্রতিযোগিতা বাড়ছে। কাজ না করলে ছেঁটে দেওয়ার একব¹া মনোভাব কর্তৃপক্ষের। চাকুরি হারানোর খাঁড়া ঝুলছে প্রতিটি কর্মীর মাথার উপর। কম টাকায় কাজ করিয়ে নেওয়ার একটা প্রবণতা আছে কর্তৃপক্ষের। ফলে, দারুণ পারফর্ম করলেও কোন কর্মী যে হাতে ‘পিঙ্ক স্লিপ’ পাবে না, তার নিশ্চয়তা নেই।
দীর্ঘ কাজের সময়
কাজ হারানোর ভয় সব সময় কুরে কুরে খাচ্ছে কর্মীদের। ফলে সহকর্মীকে টেক্কা দিতে মরিয়া অন্য কর্মী। কাজ, আরও কাজ। কাজ দিয়ে বসকে বশ করতে চেষ্টা অব্যাহত কর্মীদের। খাওয়া ভুলে কাজে ডুবিয়ে রাখছে নিজেদের। পেটে চড়া পড়ছে। শরীরে এই তালে ঢুকে পড়ছে কঠিন অসুখ। শরীর তো যাচ্ছেই, দীর্ঘক্ষণ কাজ করার ফলে মনও শুকিয়ে আমসি হয়ে যাচ্ছে।
চাকরির অনিশ্চয়তা
বাজারে প্রতিযোগিতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, লে আউড, রিসিশন, নতুন টেকনোলজি ইম্পিমেন্ট, আউট সোর্সিং, ক্রাউড সোর্সিং এবং উন্নতর প্রযুক্তির কর্মীদের অলস করে দিচ্ছে। তবে, পরিস্থিতির চাপে কর্মস্থলে নিজেদেও অস্তিত্ব বজয় রাখতে চেষ্টার কসুর করছে না কর্মীরা। যেনতেন প্রকারেণ চাকরি যে টিকিয়ে রাখতে হবে। ফলে, পিছনে ছুরি মারা, অন্যের কাজে নিজের কৃতিত্ব দাবি করার প্রবণতা বাড়ছে কর্মীদের মধ্যে।
প্রযুক্তি
কম্পিউটার আর মোবাইল তৈরি হল কেন? জীবনে গতি আনতে, জীবনকে আরও সহজ করতে। কিন্তু, সমস্যা অন্য জায়গায়। প্রতিদিনই কিছু না কিছু প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে। কর্মীদের উপর চাপ বাড়ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করার। প্রযুক্তির অগ্রগতিতেও কাজের চাপ বিন্দুমাত্র কমছে না, বরং বাড়ছে হু হু করে। কারণ, আরও ভাল কাজ করার, আরও বেশি কাজ করার আবদার আসছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেও কাছে থেকে।
বৈষম্য
কাজের জায়গায় বৈষম্য একটা মস্ত ব্যাপার। এটা ঘটে মূলত লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম অথবা নাগরিকত্বের কারণে। সহকর্মী বা মালিকপক্ষেও বাঁকা দৃষ্টিতে সব সময়ই চাপে ফেলছে ওই কর্মচারী।
নিপিড়ন
কিছু কিছু ইন্ডাস্ট্রিতে নিপিড়ন একটা মারাত্মক ব্যধি। কর্মস্থলে সবচেয়ে বেশি নিপিড়নের শিকার হতে হয় কর্মীদের। তা হল যৌন নিপিড়ন। নারী হোক বা পুরুষ, এই নিপিড়নের কোনও ভেদ নেই। শুধু যৌন নিপিড়ন নয়, অন্য প্রকার শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারও বিরাজ করে কর্মস্থলে।
কর্মস্থলে চাপের লক্ষণ
অফিসে চাপের লক্ষণকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। কিছু লক্ষণ সাধারণত, কিছু লক্ষণ অফিসভেদে আলাদা। মনস্তাত্ত্বিক লক্ষণের মধ্যে রয়েছে ডিপ্রেশন, ট্রমা পরবর্তী চাপের ফলে ভারসাম্য হারানো, উদ্বেগ প্রভৃতি। আবেগের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে অসন্তোষ, নেতিবাচকতা, মেজাজ পরিবর্তন, ক্লন্তি, একঘেয়েমি এবং ফ্রাস্টেশন। ব্যবহারিক লক্ষণের মধ্যে রয়েছে আগ বাড়িয়ে ফেলার মানসিকতা, মাদকাশক্তি, অল্পেতেই বিরক্তি প্রকাশ। যার ফলে সম্পর্ক ভেঙে যায়, চরম অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক ভয় আক্রমণ করে।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে মনোযোগের অভাব, স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যাওয়া, নির্ধারিত সময়ে কোনও সহজ কাজ শেষ করতে না-পারা, কোনও সহজ কাজ শেষ করতে না-পারা, কোনও সহজ সমস্যার সমাধান অহেতুক হাতড়ে বেড়ানোÑ ঘটতে পারে এমন ঘটনাও। সমস্ত চাপের শরীরিক বহিঃপ্রকাশ হল মাথাধরা, পেটের সমস্যা, হজমের গণ্ডগোল এবং অনিদ্রা। দীর্ঘদিন ধরে চাপের ফলে হার্টের সমস্যা দেখা দিতে পারে, পেশি ও হাড়ের রোগ হতে পারে এবং ক্রমশ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার পলে অন্যান উপসর্গও বাসা বাঁধতে পারে শরীরে।
চাপ থেকে পরিত্রাণের উপায়
কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাপ এড়ানো সম্ভব নয়। সে কারণেই কোনও সংস্থা কর্মীদের চাপ কাটানোয় উদ্যোগ নিলেও সুরাহ হয় না। যতই নীতি বদলানো হোক, যতই কাজের পরিবেশকে আরও স্বাস্থ্যকর করে তোলা হোক, কিছু কিছু বিষয় বদলানো সম্বব নয়। তাই এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাপের সঙ্গে লড়াই ও চাপকে জয় করার শক্তি অর্জন করতে হবে। কয়েকটি সহজ পন্থা আছে, যার দ্বারা সফলভাবে চাপকে কব্জা করা যায়।
ইতিবাচক চিন্তা-ভাবনা
অফিসে চাপ সামলানো অথবা এড়িয়ে চলার প্রাথমিক শর্ত হল ইতিবাচক ভাবনা-চিন্তা। যদি কোনও কর্মী সব বিষয়েই ইতিবাচক হন, তা হলেও সরিয়ে রাখতে পারবেন। শত বাধা সত্ত্বেও ইতিবাচক মনোভাবের মানুষ এগিয়ে চলেন সামনের দিকেই। তাঁরা চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসেন। বাধা অতিক্রম করতে তাঁদের চেষ্টার কোনও ত্র“টি থাকে না। অফিসে কাজের চাপের সঙ্গে যুদ্ধ করতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের জীবনধারা বদলে নিতে হয়। কাজের বাইরে পরিবার ও পোষ্যদেও সঙ্গে যতটা বেশি সময় কাটালে বলা হয়।
যদি কোনও শখ না থাকে তা হলে অবশ্যই কোনও একটি শখকে আঁকড়ে ধরতেই হবে। প্রত্যেকদিন শরীর থেকে ঘাম ঝরাতে হবে। তাই কোনও খেলার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে হবে, অথবা প্রত্যেকদিন ব্যায়ম করতে হবে। বদলাতে হবে খাদ্যাভ্যাসও। কফি, মদ, উত্তেজক পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। টাটকা ফল ও সবজি প্রচুর খেতে হবে প্রতিদিন।
পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকুন
পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। একটা সময় পরে পরিবর্তন হবেই। তা মেনেও নিতে হবে। যদি আপনি ঘাটের দশকের স্টাইলে স্বচ্ছন্দ হন, তবুও টিকে থাকার জন্য পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে বদলাতেই হবে। নিজের পেশার পরিবর্তনশীল বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে হবে। সেই পরিবর্তনগুলি কীভাবে নিজের জীবন ও কাজে প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে ভাবার জন্য আরও সময় দিতে হবে। কর্মস্থলে কাজপাগল মানুষেরই চাপটা বেশি। যদি তাঁরা কোনও একটা কাজ শেষ করতে না পারেন, তা হলে ভেবে নেন, তাঁরা ব্যর্থ। এই ভাবনা শরীর ও মনে চাপ ফেলে।
যাঁরা নিখুঁতভাবে কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। যদি আপনি মনে শান্তি চান এবং চাপমুক্ত হতে চান, তা হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চোখ বুজে থাকতে হবে। যখন আপনি আপনার জুনিয়রদের কাজের দেখভাল করবেন, তখন মনে রাখবেন, জুনিয়ররা পারছে না দেখে নিজেই সব কাজ করে ফেলবেন না। ‘না’ বলতে শিখুন। আপনি কাজের প্রতি আন্তরিক ও আবেগপ্রবণ বলে সবাই যদি আপনার ঘাড়েই সব সময় সব কাজ চাপিয়ে দিতে চান, তা হলে ‘না’ বলতে দ্বিধা করবেন না।
চাপ মোকাবিলার কৌশল
যখন আপনার স্নায়ু উত্তেজিত হতে থাকে, যখন উদ্বেগ গ্রাস করতে থাকে, তখন কী করবেন? স্নায়ুকে একটু বিরাম দিন। তার জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল, ব্যায়ম কৌশল, যোগ কৌশল গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সতেজতা এবং প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা শরীর-মন পেতে কিছুটা কসরত করুন। যা সারাদিন আপনাকে রাখবে ‘এক্সট্রা ফ্রেশ’। পরের দিনের জন্যও আপনি পাবেন বাড়তি অক্সিজেন। তখন চাপ ‘বাপ বাপ’ বলে পালাতে পথ পাবে না।
আরও পড়ুন: