পেশাজীবীদের সামাজিক অবস্থা 

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পেশাজীবীদের সামাজিক অবস্থা ।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।

পেশাজীবীদের সামাজিক অবস্থা

বাংলার প্রাচীন সমাজ কৌম দ্রাবিড় সমাজের অন্তর্গত ছিল। মুসলমানদের আগমন ও মুসলিম শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ব্যবস্থা আশরাফ ও আতরাফ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। সামাজিক এ বিভাজন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিরাজমান ছিল। ‘বর্ণাশ্রম’ প্রথায় প্রাচীন হিন্দু সমাজ অনেক বর্ণ এবং উপবর্ণে বিভক্ত ছিল।

‘বৃহদ্ধর্ম্ম পুরাণ’ ও ‘ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে ব্রহ্মণ ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র চারটি প্রধান বর্ণ ও ছত্রিশটি উপবর্ণের উল্লেখ রয়েছে। প্রকৃত অর্থে আর্যদের চতুবর্ণ প্রথা বাংলাদেশের সমাজে কখনো পুরাপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ড. রংগলাল সেন প্রাচীন ভারতের গ্রামের পরিবেশের সাথে আর্যদের প্রধান বর্ণভিত্তিক সমাজের একটি সাজুয্য দেখতে পান।

 

পেশাজীবীদের সামাজিক অবস্থা 

 

তিনি লিখেছেন— ব্রাহ্মণরা গৌরবর্ণের অধিকারী। এটি পবিত্রতা ও সাত্ত্বিকতার লক্ষণ। তারা গ্রামের সাদা মাটির এলাকায় বসবাস করে। ক্ষত্রিয়দের গায়ের রং লাল যা সৌর্য ও বীর্যের প্রতীক। গ্রামের মাটি যেখানে লাল সেখানেই ক্ষত্রিয়রা থাকে। বৈশ্যদের শরীরের রং হলুদ। এটি সোনার রং যা ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য। হলুদ রং-এর মাটি যেখানে সেখানেই বৈশ্যদের বাস। শূদ্ররা কাল, কাদামাটির কাছাকাছিই এদের বাস।

আর্যদের প্রচলিত বর্ণব্যবস্থায় সমাজে ব্রহ্মণ সমাজের কাজ ছিল পূজা অর্চনা করা, ব্যাকরণ পুরাণ বেদ, জ্যোতিষ ইত্যাদি চর্চা করা। ব্রহ্মণরা টোল বা চতুষ্পাঠিতে শিষ্যদের পাঠদান করত। সে সময় রাজ আনুগ্রহে বা জমিদারদের কৃপায় ব্রাহ্মণরা প্রচুর অর্থ ও ভূমির মালিক হয়েছিলেন। অনেক ব্রাহ্মণ ভূম্যধিকারী হয়েছিলেন।

প্রাচীনকালে কায়স্থরাও অনেক উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কালক্রমে এরা সামন্ত প্রভু হিসেবে আবির্ভূত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা বৈশ্যগণ জীবিকা নির্বাহ করত। উপর্যুক্ত চতুবর্ণ ছাড়াও বাংলাদেশে ব্যাধ, ভাড়, কোল, কোথত, নাপিত, মোদক, তেলী, মালি, ডোম, শবর, চাড়াল কাপালী প্রভৃতি পেশাজীবী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। প্রাচীন বাংলায় বসবাসকারী অস্পৃশ্য সম্প্রদায় সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।

অস্পৃশ্য সম্প্রদায়, শহরের বাইরে, গ্রামের একপাশে, বিচ্ছিন্ন টিলা, উপত্যকায় বা নৌকায় বসবাস করত। বাঁশের তাঁত, চাঙারি ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রি ছিল এদের বৃত্তি। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ছিল প্রধানত কৃষিভিত্তিক।

গ্রাম বাংলার অসংখ্য খাল-বিল, নদী- নালা, হাওড়-বাওড় পারাপারের জন্য মাঝি বা খেয়ামাঝি বা পাটনিরা কাজ করত। গ্রামের কৃষিকাজ চালাতো ক্ষেত্রকার বা কৃষক। কৃষকদের সাহায্য করত ভূমিহীন কৃষিজীবী।এছাড়াও মহত্তর, কুটাম্বর প্রভৃতি ছোট ছোট ভূস্বামীরাও এ কাজে সহযোগিতা করতো।

মার্কসবাদী অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বাংলার গ্রামীণ সমাজ পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। প্রথমত জমিদার-জায়গীরদার-মহাজন-ব্যবসায়ী। দ্বিতীয়ত সামন্ত ভূস্বামী শ্রেণী। তৃতীয়ত স্বাবলম্বী মধ্যস্তরের কৃষক শ্রেণী। চতুর্থত নিম্নস্তরের কৃষকসমাজ।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

পঞ্চমত ভূমিহীন কৃষকশ্রেণী। উপর্যুক্ত শ্রেণীসমূহের মধ্যে পাওয়া যায় রাজপাদোপজীবী, ভূম্যধিকারী আমলা, পুরোহিত কৃষক, বণিক, ব্যবসায়ী, মহাজন ও কায়িক শ্রমজীবী। অজয় রায়, বাঙলা ও বাঙালী গ্রন্থে সেসময়কার শহরের অবকাঠামো আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন— রাজা ও রাজ পুরুষ ছাড়া শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, কুলিক প্রভৃতি ব্যবসা শিল্পীরাই ছিলেন শহরবাসী।

ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য জ্ঞানজীবী বা ধর্মজীবীরাও শহরে বাস করতেন। শহরে আরও থাকতেন কর্মকার, কাংস্যকার, শঙ্খকার প্রভৃতি শিল্পীরা। সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, অট্টালিকাকার প্রভৃতি পেশাজীবীরাও ছিলেন শহরবাসী, রজক, নাপিত, সেবকদের অনেকেই বাস করতেন শহরে। ডোম চন্ডালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শহরের বাইরে বাস করত।

মোগল শাসন আমলে গ্রামীণ সমাজের সামাজিক শ্রেণীগুলো ছিল এরূপ—উচ্চ হিন্দু সম্প্রদায়ের জাতিবর্ণ, কৃষক ও গ্রামীণ কারিগর, ভূমিহীন মজুর, গ্রামের সামন্তপ্রভু, ভূম্যধিকারীদের গৃহস্থলীর কাজে নিয়োজিত শ্রেণী। নীহার রঞ্জন রায় বাঙালীর ইতিহাস গ্রন্থে পেশাজীবীর সামাজিক অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে বর্ণনা করেন— রাজা, রাজপাদোপজীবী, শিল্পী, বণিক, কৃষক বুদ্ধিজীবী, ভূমিবান সম্প্রদায়ের শ্রেণীর লোকের জন্য সেবাদানকারী

লোক নিয়োজিত থাকতো। দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য নানা শ্রেণীর বৃত্তিজীবীর অবস্থান ছিল সমাজে। মধ্যযুগীয় সমাজে সামন্তপ্রভু ও জমিদার শ্রেণী শোষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনের ফলে এদের সমাজ- সংস্কৃতি ও বৃত্তির উপর প্রভাব পড়ে।

মুসলমানরাও আর্যদের মত সমাজে উচ্চশ্রেণী ও নীচুশ্রেণী আশরাফ ও আতরাফ হিসেবে তাদের অবস্থান প্রকাশ করতে থাকে। সমাজে উচ্চবংশের মুসলমানদের পদবী ছিল – সৈয়দ, সিদ্দিকী, খন্দকার, মীর, শেখ, মোগল, পাঠান ইত্যাদি।

 

পেশাজীবীদের সামাজিক অবস্থা 

 

অপর দিকে নিম্ন কর্ম বা বৃত্তির কারণে অপর শ্রেণীর মুসলমানগণ ছিল— জোলা, নিকেরি, পিঠারি, সানকার, হাজাম, কাগতি, দরজি, কসাই প্রভৃতি। ভারতীয় হিন্দু বর্ণধর্ম ব্যবস্থায় মধ্যযুগীয় সামন্ত সমাজে অন্ত্যজদের অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে পরিব্রাজক আলবেরুনী উল্লেখ করেন— এদেশে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈশ উচ্চশ্রেণীভুক্ত। অধম যারা তারা হচ্ছে মেহনতী বা শ্রমজীবী মানুষ।

এদের কোনো বিশেষ বর্ণ বলে গণ্য করা হয় না, পেশা বা জীবিকাই এদের বর্ণ। এদের অন্ত্যজ বলা হয়। এদের কর্তব্য হচ্ছে সেবা যাতে উচ্চবর্ণের প্রত্যেকেই তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের সামন্ত সমাজে কৃষক, তাঁতি, জেলে, বারুই, হাজাম, মোদক, গোয়ালা, শাখারু, কর্মকার, সূত্রধর, নিকেরি, ধোপা, নাপিত, দরজি, তুলকার, মালাকার, পটুয়া, তাম্বুলী, শুড়ি, প্রভৃতি নিম্নবৃত্তের লোকেরা সমাজে অবহেলিত হয়েছে সমাজে এদের অবস্থান সুদৃঢ় হয়নি।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment