আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বৌদ্ধ হিন্দু মুসলমান ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।
বৌদ্ধ হিন্দু মুসলমান ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা
প্রাচীন বাংলার মানুষ ‘কৌম’ সমাজে বসবাস করতো। কৌম সমাজে ছিল খশ, যবন, কম্পোজ, দেবল ইত্যাদি গোষ্ঠী। আর্যদের আগমনে এদেশে কৌম সমাজ ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ে। আর্যরা এদেশে বর্ণভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। বর্ণ প্রথা প্রচলিত হয়।
বর্ণ ও বৃত্তি অনুযায়ী সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্যদের মধ্যে—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- —এই চার বর্ণ ছিল। কালক্রমে মিশ্র বর্ণের সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় উপবর্ণের। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ-এ আর্যদের উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অধম সংকর এই তিন পর্যায়ে ছত্রিশটি উপবর্ণসহ সর্বমোট একচল্লিশটি উপবর্ণের উল্লেখ রয়েছে।
ব্রাহ্মণরা সমস্ত শূদ্র সংকর উপবর্ণগুলিকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে এবং প্রত্যেকটি উপবর্ণের স্থান ও বৃত্তি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। উত্তম সংকর পর্যায়ের বিশটি উপবর্ণ : (১) করণ– এঁরা লেখক ও পুস্তক কর্মদক্ষ এবং সৎশূদ্র হিসেবে পরিগণিত (২) অম্বষ্ঠ—এঁদের বৃত্তি চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদ চর্চা, সে জন্য এঁরা বৈদ্য বলে পরিচিত। ওষুধ প্রস্তুত করতো।
বলে এঁদের বৃত্তি বৈশ্যের, কিন্তু ধর্মকর্মানুষ্ঠানের ব্যাপারে এরা শূদ্র বলে পরিচিত। (৩) উগ্র – এঁদের বৃত্তি ক্ষত্রিয়ের, যুদ্ধবিদ্যাই এঁদের ধর্ম। (৪) মগধ হিংসামূলক যুদ্ধব্যবসায়ে অনিচ্ছুক হওয়ায় এঁদের বৃত্তি নির্দিষ্ট ছিল সূত বা চারণের এবং সংবাদবাহীর। (৫) তন্ত্রবায় (তাঁতী)। (৬) গন্ধবণিক (গন্ধদ্রব্য বিক্রি যে বণিকের বৃত্তি, বর্তমানের গন্ধবণিক)। (৭) নাপিত (ক্ষৌরকার)। (৮) গোপ (লেখক)। (৯) কর্মকার (কামার)।
(১০) তৈলিক বা তৌলিক (গুবাক-ব্যবসায়ী)। (১১) কুম্ভকার (কুমোর)। (১২) কংসকার (কাঁসারী)। (১৩) শাংখিক বা শংখকার (শাঁখারী)। (১৪) দাস-কৃষিকাজ এঁদের বৃত্তি, অর্থাৎ এরা চাষী।
(১৫) বারজীবী (বারুক, পানের বরজ উৎপাদন করা এঁদের বৃত্তি)। (১৬) মোদক (ময়রা)। (১৭) মালাকার। (১৮) সূত-বৃত্তির উল্লেখ নেই, অনুমান করা হয়, এঁরা চারণ গায়ক ‘পতিত ব্রাহ্মণ’। (১৯) রাজপুত্র (বৃত্তির উল্লেখ নেই, রাজপূত ?)। (২০) তাম্বলী (তামলী-পান বিক্রেতা)।
মধ্যম সংকর পর্যায়ের বারটি উপবর্ণ : (২১) তক্ষণ (খোদাইকার)। (২২) রজক। (২৩) স্বর্ণকার (সোনার অলঙ্কার প্রস্তুতকারক)। (২৪) সুবর্ণ বণিক (সোনা ব্যবসায়ী)। (২৫) আভীর (আহীর – গোরক্ষক)। (২৬) তৈলকার (তেলী)। (২৭) ধীবর (মৎস্য ব্যবসায়ী)। (২৮) শৌণ্ডিক (শুঁড়ি)। (২৯) নট (যারা নাচে, খেলা ও বাজি দেখায়)। (৩০) শাবাক, শাবক, শাবার (?)। (৩১) শেখক। (৩২) জালিক (জেলে, জালিয়া)।
অধম সংকর পর্যায়ের নয়টি উপবর্ণ : (৩৩) মলেগ্রহী (বঙ্গবাসী সং মলেগৃহি)। (৩৪) কুড়র (?)। (৩৫) চণ্ডাল (চাড়াল)। (৩৬) বরুড় (বাউড়ী?)। (৩৭) তক্ষ (তক্ষণকার)।(৩৮) চর্মকার (চামার)। (৩৯) ঘট্টজীবী (খেয়াঘাটের মাঝি)। (৪০) ডেলোবাহী (ডুলিবেহারা)। (৪১) মল্ল (বর্তমানে মালো)।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও অনুরূপ বর্ণ বিন্যাস ও বৃত্তির বিবরণ পাওয়া যায়। এখানে সৎ শূদ্র ও অসৎ শূদ্র এ দুভাবে শ্রেণী ও বৃত্তির বিন্যাস করা হয়েছে।
সৎ শূদ্রের বর্ণ বিন্যাস অনুযায়ী বৃত্তির তালিকা : (১) করণ। (২) অম্বষ্ঠ। (৩) বৈদ্য (বৃত্তি-চিকিৎসা)। (৪) গোপ। (৫) নাপিত। (৬) ভিন্ন। (৭) মোদক। (৮) কবর। (৯) তাম্বুলী (তালী)। (১০) স্বর্ণকার ও অন্যান্য বণিক। (১১) মালাকার। (১২) কর্মকার। (১৩) শংখকার। (১৪) কুবিন্দক (তন্তুবায়)। (১৫) কুম্ভকার। (১৬) কংসকার। (১৭) সূত্রধর। (১৮) চিত্রকার (পটুয়া)। (১৯) স্বর্ণকার।

অসৎ শূদ্রের বর্ণ বিন্যাস অনুযায়ী বৃত্তির তালিকা : (২০) অট্টালিকাকার। (২১) কোটক (ঘরবাড়ি তৈরি করা যাদের বৃত্তি)। (২২) তীবর। (২৩) তৈলকার। (২৪) লেট। (২৫) মল্ল। (২৬) চর্মকার। (২৭) শুঁড়ি। (২৮) পৌণ্ডক (পোদ ?)। (২৯) মাংসচ্ছেদ (কসাই)। (৩০) রাজপুত্র (পরবর্তী কালে রাউত)। (৩১) কৈবর্ত (কোলিযুগের ধীবর)। (৩২) রজক। (৩৩) কৌয়ালী। (৩৪) গঙ্গাপুত্র। (৩৫) যুঙ্গি (যুগী?)। (৩৬) আগরী (বর্তমানে আগুরী)।
এ সমস্ত বর্ণ বিভাজন এবং বর্ণ বিভাজনে বৃত্তি বা পেশার বিবরণ পাওয়া যায়। প্রাচীন ও বর্তমান বাংলাদেশেও এ সমস্ত বর্ণ বিভাজন ও এর ভিত্তিতে বৃত্তির প্রচলন ছিল ও আছে। এ সমস্ত বর্ণভিত্তিক সম্প্রদায় ছাড়াও বাংলাদেশে পেশাভিত্তিক পদবি-পরিচয়ের প্রচলন দেখা যায়।
তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি পেশাজীবীর উল্লেখ করা যায়। যেমন : গায়ক-গায়েন, বাদক—বায়েন, কবি-কবিয়াল, শস্য-মাপজোখকারী-কয়াল, পাল্কিবাহক—বেহরা, জেলে- নিকারি ইত্যাদি।
বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস গ্রন্থে বৃত্তিজীবীদের বিবরণ পাওয়া যায় এরকম— ব্রাহ্মণরা মৃতদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পৌরহিত্য করতেন, কুলপঞ্জি পাঠ করতেন, ঠিকুজী বা কুষ্টি গণনার কাজ করতেন। বৈদ্যরা চিকিৎসা করতো। বৈশ্যেরা কৃষিকাজ করতো। গোপরাও কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল। গোয়ালা জাতীয় শ্রেণী দুগ্ধজাত দ্রব্যের ব্যবসা করতো।
তেলীরা গৃহে ফান (তৈল নিষ্কাশন যন্ত্র) রাখতো। তারা তৈল ব্যবসা করতো। কাসারু (কংশকার)। কুম্ভকার (মৃৎপাত্র নির্মাতা)। তাম্বলী (পানশুপারী বিক্রেতা)। তন্তুবায় (বস্ত্র বয়ণকারী)। মালী (পুষ্প ও মালা ব্যবসায়ী)। বারুই (পান উৎপাদনকারী)। নাপিত চর্ম নির্মিত বর্ম ও হাতে আয়না নিয়ে ঘুরে বেড়াত। তারা চুল কেটে জীবিকা নির্বাহ করতো। মুদক (মিষ্টান্ন প্রস্তুত কারক)।
বাউরী (গ্রাম্য গায়ক)। বাগদী (গ্রামের যোদ্ধা লোক)। ধোপা (রজক)। দর্জী (পোষাক প্রস্তুতকারী)। ছুতার (কাঠমিস্ত্রি)। ধীবর (মৎস্যজীবী) এবং চণ্ডালেরা ও অন্যান্য অন্ত্যজ শ্রেণীভুক্ত লোকেরা শহর ও পল্লীর শেষ প্রান্তে বসবাস করতো।
প্রাচীনকাল থেকে উনিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিল স্বনির্ভর গ্রাম- ব্যবস্থা। কৃষি উৎপাদন অর্থনীতিতে গ্রামগুলো ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ। বাংলাদেশের প্রাচীন কৃষিজ উৎপাদন-ব্যবস্থা এবং এদেশের অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল হাওড়-বাওড় এ স্বনির্ভর গ্রামীণ সমাজের অনেক দিন ধরে কোনো বদল হয়নি।
কৃষিনির্ভর গ্রাম বাংলার মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রব্যাদি উৎপাদন করতো। নিজেদের চাহিদা মেটাতো এবং রপ্তানি করতো। বাংলাদেশ থেকে চাউল, চিনি, মরিচ, সুতিবস্ত্র, তৈজসপত্র, মধু, লবণ ইত্যাদি নদী-পথে এবং সমুদ্র-পথে বিদেশে রপ্তানি করা হতো।
আর্যদের প্রচলিত বর্ণ ভিত্তিক সমাজ কাঠামোতে এবং হিন্দু-বৌদ্ধ শাসন আমল পর্যন্ত বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোতে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন সংঘটিত হয়নি। মৌর্যবংশ, গুপ্ত—বংশ, পাল-বংশ ও সেন-বংশ দীর্ঘদিন ধরে বাংলায় শাসনকার্য চালিয়েছে। রাজ্য শাসনের জন্য তারা কাজের ভিত্তিতে বিচার বিভাগ, শান্তিরক্ষা বিভাগ, সৈন্য বিভাগ প্রবর্তন করে।
এ-সময় বাংলায় মন্দির ও বৌদ্ধবিহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। বাংলার ময়নামতী, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়ে প্রাচীন পুরাকীর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়। এ থেকে সেকালে এদেশে ওস্তাগার, মৃৎশিল্পীদের অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। এ ছাড়া তামা ও ব্রোঞ্জ শিল্পের ব্যবহার সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।
বাংলার গ্রামের মানুষ শন, কাঠ, বাঁশ-বেতের ব্যবহার করতো। প্রচুর শনের ঘর ছিল বাংলাদেশে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে খড়ের ঘরের বিবরণ পাওয়া যায়। চর্যাপদে আছে ‘চারিপাশে ছাইলারে দিয়া চঞ্চালী’। জলপথে নানা ধরনের সুসজ্জিত জাহাজ, নৌকা চলাচল করতো। স্থলপথে রথ, গরুর গাড়ি, ডুলী, পাল্কী ইত্যাদিতে মানুষ চলাচল করতো।
রাজা লক্ষণ সেনের পতনের পর এ দেশে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলাদেশ জয় করেন। হযরত শাহজালাল, হযরত খানজাহান আলী প্রভৃতি পীর-দরবেশের আগমন ঘটে এদেশে। ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার লাভ করতে থাকে। আরব বণিকরা এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকে।
মুসলমান শাসকেরা দীর্ঘদিন এ দেশ শাসন করে। মুসলিম শাসনামলে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোয় বৃত্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছু শ্রেণীগত পরিবর্তন আসে। মুসলমানদের শাসনামলে এদেশে গড়ে ওঠে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব।
সরাইখানা, রাস্তাঘাট, ডাক ব্যবস্থার প্রচলন হয়। সুবেদার, জায়গীরদার, মনসবদারি প্রথা এ-আমলেই প্রচলিত হয়েছিল। বিচার প্রথা, জমির জরিপ, খাজনা আদায় ইত্যাদি প্রথা এ-সময় চালু হয়। মুসলমান শাসন আমলে সাহিত্যচর্চাও সমৃদ্ধ লাভ করে।
১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এদেশে আসে। বাণিজ্য করার সাথে সাথে এ উপমহাদেশে স্থায়ী উপনিবেশ গড়ার কাজও গোপনে গোপনে তারা চালিয়ে যায়। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের সাথে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পলাশির প্রান্তরে যুদ্ধ হয়।
যুদ্ধে সিরাজের পতন ঘটে। ইংরেজরা এদেশের শাসনভার গ্রহণ করে। বাংলার উৎপাদিত কৃষিজাত কাঁচামালের প্রতি ইংরেজদের লোভ ছিল দীর্ঘদিনের। ঊনিশ শতকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশ থেকে প্রচুর কাঁচামাল সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডের কল-কারখানার জন্য পাঠাতে থাকে।
ইংল্যান্ডের কল-কারখানায় উৎপাদিত দ্রব্যাদি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে এদেশে আমদানি হতে থাকে। বাংলাদেশের কুটির শিল্প বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ইংরেজ শাসক এদেশের বস্ত্র শিল্পের উপর কর আরোপ করে। ইংল্যান্ডের তৈরি বস্ত্র অবাধে আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। ফলে বাংলাদেশের সমৃদ্ধশালী বস্ত্র শিল্পের চরম অবনতি ঘটে।
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পত্তন ঘটায়। ফলে বাংলাদেশের ভূমি-ব্যবস্থার বিরাট পরিবর্তন ঘটে। উদ্ভব হয় জমিদার-ভূস্বামী এবং প্রজা-রায়ত শ্রেণীর। জমিদার ভূ-স্বামীদের স্বার্থরক্ষার জন্য মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে।
ইংরেজরা এদেশে রাস্তাঘাট নির্মাণ, রেল গাড়ির প্রচলন, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং শহর-নগর-বন্দর গড়ে তোলে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হয়। ফলে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত চাকুরিজীবী শ্রেণীর উদ্ভব হয়। ইংরেজরা এভাবে এদেশের সমাজ-কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে।
আরও দেখুনঃ