আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মুল্লঙ্গী বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।
মুল্লঙ্গী বাংলাদেশের পেশাজীবী
সমুদ্রের পানি আগুনে জ্বাল দিয়ে এবং সৌরতাপে শুকিয়ে সেকালে এদেশে লবণ উৎপাদন হত। যারা লবণ উৎপাদন করত তারা মুলঙ্গী/লবণিঞা নামে পরিচিত ছিল। লবণ উৎপাদন ক্ষেত্রকে ‘তোফল’ বলা হয়। মোগল আমলে দু’টি সরকারী বিভাগ কর্তৃক লবণ শিল্প নিয়ন্ত্রণ করা হতো। বিভাগ দু’টো হলো—নিমক জায়গীর মহাল এবং নিমক এয়জ মহাল।
ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী শাসনের প্রথম দিকে মুলঙ্গীরা ৭৯ হাজার মন থেকে ৯৯ হাজার মন লবণ উৎপাদন করত। ব্রিটিশ সরকার সারা ভারতে সামুদ্রিক লবণ উৎপাদন করা বেআইনী ও জেল-জরিমানা দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে। ব্রিটিশ সরকার তাদের ব্যবসায়ী প্রতিনিধির মাধ্যমে এদেশে লবণ আমদানি শুরু করে।
সে সময় চট্টগ্রামের বহু গরীব মুলঙ্গী পেটের দায়ে গোপনে অল্পস্বল্প লবণ প্রস্তুত করে জীবন ধারণ করত। অনেকে সেজন্য ধরা পড়ে জেল জরিমানা ভোগ করেছে। সে সময় ব্রিটিশ সরকার নির্যাতন চালিয়ে এদেশের প্রাচীন লবণ শিল্প ও লবণ প্রস্তুতকারী মুলঙ্গী পরিবারকে ধ্বংস করে।
চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার নানুপুর গ্রাম মুলঙ্গী পাড়া এখনও রয়েছে। সৌরতাপে সমুদ্র উপকূলে বেড়ি বাঁধের মধ্যে Salt bed লবণ ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। সমুদ্রের লোনাপানি বন্ধ করে রাখার জন্য বেড়ি বাধ দিতে হয়। বেড়ি বাধের মধ্যে ৫-৭টি Salt bed প্রস্তুত করা হয়। অতঃপর লবণ ক্ষেত্রগুলোতে জোয়ারের পানি ঢুকলে গেট বন্ধ করে দেয়া হয়।
পানির জলীয় অংশ সূর্যের তাপে বাষ্পীয় হয়ে যায় এবং সেখানে দানা বেঁধে লবণের স্তর সৃষ্টি হয়। বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন করা হয়। ১৯৮৪-৮৫ সনে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থার জরিপ অনুযায়ী তেত্রিশ হাজার চারশত পনের একর জমিতে এক কোটি ছিয়াত্তর লক্ষ বাষট্টি হাজার মন লবণ উৎপাদিত হয়।
তবে ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থার আওতার বাইরে সমবায়ী ও স্বতন্ত্রভাবে লবণ উৎপাদন করে এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোটামুটি তিন লক্ষ লোক এই শিল্পের নিয়োজিত আছে বলে মনে করা হয়।
এছাড়াও চট্টগ্রামের ধর্মপুর গ্রামের তকিরহাটের পূর্বে মুলঙ্গী ভিটা বর্তমানে বিদ্যমান সমুদ্রে নোনা জল থেকে লবণ তৈরির প্রক্রিয়া বাংলাদেশের মানুষ একাদশ শতাব্দীতে থেকে জানতো বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়।
একাদশ শতাব্দীতে রামপাল ও দ্বাদশ শতাব্দীতে ভেলবা তাম্রফলকে শচীন্দ্র ও ভাজব্রাহ্মণ কর্তৃক ‘সলবন’ দু’টি গ্রাম দানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সিজার ফ্রেডারিক একজন ভেনেসীয় পর্যটক সন্দ্বীপ থেকে বছরে দুশ লবণ ভর্তি জাহাজ বাইরে পাড়ি দিতো বলে উল্লেখ করেছেন। মুসলান শাসন আমলে লবণ- উৎপাদন প্রসার লাভ করে। তখন পঁয়তাল্লিশ হাজার মলঙ্গী বছরে বিশ লাখ মণ লবণ উৎপাদন করতো বলে জানা যায়।
মলঙ্গীরা ভরণপোষণের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ লাখেরাজ জমি ছাড়াও উৎপাদন মৌসুমে মাসে এক টাকা করে তলব পেতো। উৎপাদনের স্থান থেকে মাঝিরা নৌকায় করে লবণ গোলায় তুলতো। মলঙ্গীরা নদী বা খালের নিকটে অবস্থিত খালারী জমি একস্তর মাটি কেটে ফেলে জমির চারপাশে আল বাধাতো। তারপর জমি চাষ দিয়ে এবং পা দিয়ে জমি মাড়িয়ে দেয়া হতো।
এতে লবণযুক্ত মাটি ধুলা আকারে উপরে উঠে আসতো। একই সাথে নদী বা খালের ধারে দুই। তিন হাত গর্ত তৈরি করা হতো। জোয়ারের সময় সমুদ্রের পানিতে এ-গর্ত ভরে যেতো। রোদ পাওয়ার পর এ পানি ও মাটি একসাথে মিশিয়ে পিপাতে রাখা হতো।
পিপার তলায় ছিদ্র করে পানিযুক্ত লবণ মাটির হাড়িতে ছাঁকনি প্রক্রিয়ায় ভর্তি করা হত। তারপর জ্বালা দিয়ে লবণ প্রস্তুত করা হতো।চট্টগ্রাম থেকে খুলনার সীমানা পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের সমুদ্রোপকূলেই লবণ তৈরির স্থান ছিল। কুতুবদিয়া, নিজামপুর, নোয়াবাদ, কুরুনকুল, জুলদিয়া ও রেতিয়ায় প্রভৃতি স্থানে লবণ- উৎপাদন হতো।
বরিশাল, পটুয়াখালী জেলার বুজুর্গ উমেদপুর, মানপুরা এককালে ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লবণ উৎপাদনকারী এলাকা। খুলনার শিবপুর, রামপুর, মালাই, জমিরা প্রভৃতি স্থানে লবণ উৎপাদন কেন্দ্র ছিল বলে জানা যায়। বর্তমান লবন উৎপাদন বিভিন্ন কোম্পানীর হাতে। লবন উৎপাদনকারীরা কোম্পানীর কর্মচারী হিসেবে কাজ করে।
আরও দেখুনঃ