আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় লাঠিয়াল বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।
লাঠিয়াল বাংলাদেশের পেশাজীবী
গ্রামের দেশ বাংলাদেশ। এদেশ শাসন করেছে পাল, সেন, মোগল, ব্রিটিশ অধিপতিরা। বাংলাদেশের সামাজিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের ধারায় উদ্ভব হয়েছে ভূ-নৃপতিদের। ১৭৯৩ সালে জমিদারী প্রথার প্রবর্তনের ফলে এদেশে স্থায়ী ভূ-স্বামীদের আবির্ভাব ঘটে। জমিদার- জায়গীরদের সুবেদার বা সামন্ত ভূস্বামী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
বিশাল বিশাল এলাকার ভূ-অধিপতিরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সৃষ্টি করে লাঠিয়ালদের। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্যও তাদের লাঠিয়াল বাহিনীর প্রয়োজন পড়ে। লাঠিয়ালরা জমিদার- জায়গীরদার-তালুকদারদের অধীনস্থ নিজস্ব বাহিনী হিসেবে লালিত-পালিত হতে থাকে।
লাঠিয়ালরা জমিদার-তালুকদার-জায়গীরদারদের পোষ্য হিসেবে কাজ করতো। এরা ছিল তাদের আজ্ঞাবহ। ভূ-স্বামীদের চৌহদ্দির মধ্যেই ছিল এদের বসবাস। লাঠিয়ালদের খাওয়া পরা এবং তাদের পোষ্যদের ব্যয় ভারও জমিদার জায়গীরদার-তালুকদার বহন করত। জমিদার-জায়গীরদার-তালুকদারদের করার আশেপাশেই লাঠিয়ালদের বসবাসের জন্য বাড়ি-ঘর তৈরি করে দেয়া হতো।
লাঠিয়ালদের মাঝে একজনকে সর্দার মনোনীত করা হতো। সর্দারের নির্দেশ পুরো লাঠিয়াল বাহিনী পরিচালিত হতো। প্রাচীন বাংলাদেশে লাঠিয়ালদের কাহিনী কিংবদন্তী হয়ে আসছে। লাঠিয়ালদের প্রতিপত্তি, শৌর্য, বীর্য অনেকের কাছেই রূপকথা হিসেবে স্মরণ্যযোগ্য।
জমিদার-জায়গীরদার-তালুকদার ইত্যাদি ভূনৃপতিদের হুকুমে এরা সাধারণ মানুষদের উপর অকথ্য অত্যাচার করত। লাঠিয়ালরা ভূ-স্বামীদের হুকুম পালন করতে সাধারণ কৃষক-প্রজার জমি-বাড়ি-ঘর-বাগান—জলকর ইত্যাদি অবৈধভাবে দখল করত।
জমিদার জায়গীরদার-তালুকদারদের অভিলাস পূরণের জন্য গরীব কৃষক-প্রজার সুন্দরী বৌ-মেয়ে উঠিয়ে আনত। লাঠিয়ালরা রাজস্ব আদায়ের সময় খাজাঞ্চানির সাথে থাকতো। কোনো গরীব কৃষক-প্রজা খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের মালামাল-গরু-বাছুর জোর করে নিয়ে আসত।
খাজনা বা ফসল যথাসময়ে দিতে ব্যর্থ হলে প্রজাদের উপর নেমে আসত লাঠিয়াল বাহিনীর নির্মম অত্যাচার। লাঠিয়ালদের অত্যাচারে অনেকে ভিটেমাটি ছাড়া, গ্রাম ছাড়া হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অনেক গল্প, উপন্যাস লাঠিয়াল বাহিনী কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন রচিত ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ নকসী কাঁথার মাঠ’ কাব্যে আমরা লাঠিয়ালের উপস্থিতি দেখতে পাই। চলচ্চিত্রেও লাঠিয়াল বাহিনীর কর্মকাণ্ড প্রস্ফুটিত হয়েছে। অনেক সময় পুরুষাক্রমে লাঠিয়ালরা তাদের জমিদার-জায়গীরদারদের আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে।
বাংলার লাঠিয়ালদের লাঠির আঘাতে কত মানুষ যে তাদের স্বজনদের হারিয়েছে তা হিসাব-নিকাশ নেই। আবার প্রতিপক্ষের আঘাতে অনেক লাঠিয়ালকেও জীবন দিতে হয়েছে। অনেক সময় প্রতিপত্তি ও স্বার্থ রক্ষার জন্য দিনের পর দিন ধরে প্রতিপক্ষের সাথে লাঠিয়ালদের দাঙ্গা হয়েছে।
১৯৩৩ সালে ‘নিখিলবঙ্গ লাঠিয়াল সমিতি’ নামে লাঠিয়ালদের সমিতির আত্মপ্রকাশ ঘটে। সিরাজুল হক চৌধুরী গ্রামে-গঞ্জে লাঠিয়ালদের সংগঠিত করেছেন। তিনি লাঠিয়ালদের লাঠি চালনার কলাকৌশল নিয়ম-কানুন শিখিয়েছেন। ১৯৪৭ সালে লাঠিয়াল বাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব বাংলা লাঠিয়াল বাহিনী’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী”।
বাংলাদেশের নোয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলার নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল দখলের জন্য এখনও লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করা হয়। কালের পরিক্রমায় এখন পেশাদার লাঠিয়াল বাহিনীর অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্তির পথে। বাংলার জমিদার, জায়গীরদার, সামন্ত ভূস্বামীর বিলুপ্তি ঘটেছে। কাজেই পেশাদার বিশাল লাঠিয়াল বাহিনীর এখন আর প্রয়োজন নেই।
আরও দেখুনঃ