স্বর্ণকার বাংলাদেশের পেশাজীবী

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় স্বর্ণকার বাংলাদেশের পেশাজীবী।যা বাংলাদেশের পেশাজীবী বই এর অন্তর্ভুক্ত।

স্বর্ণকার বাংলাদেশের পেশাজীবী

বাঙ্গালী রমণীর অলঙ্কারের প্রতি দুর্বলতা আদিম ও অকৃত্রিম। পৃথিবীর প্রায় সব সমাজেই রূপচর্চার নিদর্শন পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গহনা ব্যবহারের অভ্যাস আদিকালের। এদেশে গহনা শিল্প ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ। বাংলার নারী সমাজে অলঙ্কার কেবল বিলাস নয়, এটা বাঙালি রমণীদের সংস্কার ও ধর্ম বিশ্বাসের অংশও বলা চলে।

বাঙালি রমণীর হাতে নোয়া আর নাকে সোনা না থাকলে স্বামীর অকল্যাণ হয়। সিন্ধু উপত্যকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে প্রাপ্ত সোনা-রূপা-ব্রোঞ্জের অলঙ্কার উপমহাদেশের প্রাচীনতম গহনার নিদর্শন। ঋগবেদ, মনুসংহিতা, রামায়ণ-মহাভারত, মানসামঙ্গল, পানিনি প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থে বাংলাদেশে প্রাচীনকালে গহনার প্রচলন ছিল এ বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়।

 

স্বর্ণকার বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

এ সমস্ত বর্ণনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই স্বর্ণকারদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তৃত ছিল। স্বর্ণকাররা সোনার গহনা তৈরি করে। সুবর্ণবণিক বা স্বর্ণকার আর্যদের একটি সম্প্রদায়। যাদের বৃত্তি স্বর্ণ ব্যবসা। নীহার রঞ্জন রচিত ‘বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থে সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়কে ‘মধ্যম সংকর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সুবর্ণ বণিকদের সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায়।

সুবর্ণ বণিক বৈসে,রজত কাঞ্চন কষে

পোড়ে ফোড়ে দেখিআ সংশয়

কিছু বিচে কিছু কিনে নিত্য নিত্য বাড়ে ধনে

পুর মধ্যে জাহার নিলয় ।

সুবর্ণবণিক স্বর্ণকারদেরই একটি অংশ। এরা স্বর্ণালঙ্কার বেচাকেনা করে। এ ব্যবসায় এরা পুঁজি বিনিয়োগ করে। মানুষকে ঠকানো, স্বর্ণ কষ্ঠি পাথরে ঘষে যাচাই করে কম দামে কিনে বেশী দামে বেঁচে। কবি মুকুন্দরাম স্বর্ণকারকে ‘পশ্যতোহার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। স্বর্ণকার মধ্যমসংক সম্প্রদায়ভুক্ত।

স্বর্ণকারগণ খলস্বভাবের কারণে এবং স্বর্ণ চুরির অভিযোগে ব্রাহ্মণ কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে সমাজে পতিত জাতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বগুড়ার মহাস্থানগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে প্রাপ্ত তামার বালা ও আংটি খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ থেকে প্রথম শতকের সময়কাল বলে অনুমান করা হয়।

মহাস্থানগড় ও রংপুরের সাহেবগঞ্জে প্রাপ্ত সোনার অলঙ্কার ও মুদ্রাও উক্ত সময়ের। বৌদ্ধ যুগের অলঙ্কারের মধ্যে রয়েছে— সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জের গহনা। অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীতে রচিত বাংলা চর্যাপদ থেকে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশে অলঙ্কার ব্যবহারের প্রচুর উল্লেখ পাওয়া যায়।

খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে রাজনাট্যকার শূদ্রক রূপজীবীদের বাসভবনের সঙ্গে স্বর্ণকারদের দোকান থাকতো বলে বর্ণনা করেছেন। আইন-ই-আকবরীতে সোনা-রূপার বিভিন্ন কাজের বিবরণ পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকের কবি বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল কাব্যে —

পদ্মাবতীর বিয়েতে কনের অলঙ্কারের বর্ণনা পাওয়া যায় :

“সুবর্ণের কর্ণফুল কর্ণে আনি দিল।

নাকেতে বেসর দিল করে দুল দুল ।

গলার হার ছিল সুবর্ণের পাতি।

মধ্যে মধ্যে মনিমুক্তা লাগাইছে তাতি ৷

দুই হাতে তাড় দিল দেখিতে শোভন।

শঙ্খের সম্মুখে দিল সুবর্ণের কঙ্কন।

পায় খাড়ু দিল আঙ্গুলের পাসলি।

পরমা সুন্দরী যেন সোনার পুতুলী ।

মৃগমদ মিশাইয়া চন্দন দিয়া গায় ।

কনক নূপুর দেবী তুলি দিল পায় ৷

বাংলার লোকসাহিত্যে এবং লোকসঙ্গীতে অষ্টালঙ্কারের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলার রমণীদের মাথা, নাক, কান, গলা, বাহু, হাত, কোমর ও পা শরীরের এ সমস্ত অঙ্গে বিভিন্ন নামে হরেক রকমের গয়না ব্যবহার হয়ে আসছে।

 

আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বঙ্গ ললনারা মাথায় যে সমস্ত অলঙ্কার পরতো তা ছিল—সিথি, অলকা, সিঁথিপাটি, শীরবন্দিনী, টিকলি, ললাটিকা, খুজিকাঠি, মল্লিকা, করামালা, গর্ভক, লালামক, আপীড়, চূড়ামণ্ডা, চূড়িকা, মুকুট, টায়রা, ঝাপটা, ঝাপ, বেনা, শিহারা প্রভৃতি। নাকে পরতো—বেশর, নথ, নোলক, বোলাক, বালি, চমক বালি, নাকফুল, নাকছাবি, বিজলী, ফুলগোনা, ভাঙ্গী ইত্যাদি অলঙ্কার।

কানে শোভা পেতো—কুণ্ডুল, মাকড়ী, টপ, দুল, মকর, মুণ্ডল, কানবালা, কানাপাশা, ঢেড়ি, হিরামঙ্গল, কড়ি, মদন কড়ি, চক্রবালি, বালি, গৌরণী, পাশিয়া, কানফুল, সাইরবালি, উর বইলা, ঝুমকা, গুজি, কর্ণপুর, দ্বিরাজিক, স্বর্ণমধ্য, বজ্রগর্ভ, ভুরিমণ্ডল ইত্যাদি।

বাংলার রমণীরা তাদের গলায় শোভা বর্ধনের জন্য ব্যবহার করতো—চিক, হাঁসুলী, চারজীরি, কণ্ঠি, মাদুলী, তাবিজ, ধান তাবিজ, তেলরী, সাতনরীরা, পাতেশ্বরী, চম্পাকলি, সীতাহার, অর্থহার, গজমতি, সারিকা, ভ্রমর, বর্ণসর, বজ্র, ইত্যাদি।

বাহুতে পরতো—তাড়, কেয়ুর, তাগা, আয়েন্ত পদক, মানতাসা, বাজু, বাহুসুতা, বিভা, অনন্ত জশম, টেইটি, বাক, নৌনাক, মাদুলী, কালসী, পঞ্চকা প্রভৃতি বাঙালি রমণীর হাতের শোভা বর্ধন করতো। রত্নচূড়, কেয়ূর, বলয়, বাউ, চুড়ি, বালা, তারবালা, পৈঁছি, খাড়ু, কড়া, সামযাবাদ, আলীবাদ, পাটরীচুর, রুলি, কাঁকন প্রভৃতি হাতের কব্জিতে পরা হতো।

আঙ্গুরীক মুদ্রা, মুদ্রিকা, অঙ্গুলি ও মুদ্রা ইত্যাদি আংটি পরা হতো। সুন্দরী নীম্বধারী নারীরা নিতম্বে পরতো—চন্দ্রহার, সূর্যহার, বিছা, গোথাসুতা, গোট, কোমর জের, কোমরধানী, কাঞ্চী, কিঙ্কনী, মেখলা, কলাপ, কাঞ্চীদাস, জঙ্ঘানমসুক, মশিরাসন জাতীয় অলঙ্কার।

রমণীরা পায়ে পরতো—পাস্তলী, খাড়ু, বাঁক খাড়ু, বাবেত খাড়ু, মল, মল্ল, তোড়র, মঞ্জির, পায়েল, গুঞ্জরী, নূপুর, ঘুঙুর, কিঙ্কিনী, পাহুরা, পঞ্চম কড়া, চাহাড়া, পদ্মচূড়, পাওপদ্ম, পদকণ্ঠক, মল ও আরসি। মুদ্রিকা, আঙ্গটি, চাহাল্লা, অঙ্গুস্তা, পোর ও উজঝটিকা পায়ের আঙ্গুলের অলঙ্কার। স্বর্ণকাররা কয়েকটি ভাগে সোনা রূপার কাজ করে থাকে।

সোনা-রূপার তার যন্ত্রী নামক হাতিয়ারের সূক্ষ্ম ছিদ্রের মধ্য দিয়ে টেনে ইচ্ছানুরূপ নমুনা অনুযায়ী সাজান—এটা তারের কাজ। অলঙ্কারের উপরিভাগ চোখা ত্রিকোণাকার করে কেটে নকশা করার নাম খোদাই কাজ। বিভিন্ন ডাইসে সোনা-রূপার পাত বসিয়ে পিটিয়ে নকশা করাকে ডাইসের কাজ। জিঙ্ক ও তামা মেশান পাত্রের গায়ে সোনা-রূপার পাতা বসানর কাজকে বিন্দ্রির কাজ।

 

স্বর্ণকার বাংলাদেশের পেশাজীবী

 

সোনা-রূপার উপর নমুনা মোতাবেক রিং বসিয়ে মিনা করার কাজ করা হয়। বাংলাদেশের স্বর্ণকারদের কাজের উপাদান সরল ও সাধারণ। মাটিতে একটা গর্ত, একটা পাখা বা ফুঁক— নল আর কয়েকটি অতি সাধারণ হাতিয়ার দিয়ে এরা কাজ করে তাদের শিল্পী নৈপুণ্য ফুটিয়ে তোলে।

বাংলাদেশের ঢাকা, সিলেট, যশোর, নবাবগঞ্জ ইত্যাদি স্থানের স্বর্ণকারের স্বর্ণলঙ্কার তৈরিতে বিশেষভাবে দক্ষ। প্রাচীন কালে স্বর্ণকাররা নিজেরাই স্বর্ণ ব্যবসা করতো। কিন্তু বর্তমানে চাহিদা ও প্রয়োজনের তুলনায় তাদের পুঁজি যথেষ্ট নয়। স্বর্ণব্যবসা এখন ব্যবসায়ীর হাতে এসেছে। স্বর্ণকাররা এখন স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কারিগর হিসেবে কাজ করছে।

স্বর্ণকারদের কারুকাজ দক্ষতা ও নিপুণতার নিদর্শন। অনেক সময় বংশ পরম্পরায় স্বর্ণালংকার নির্মাণের কারিগর তৈরি হয়। স্বর্ণকারগণ সাধারণ জীবন যাপন করে। স্বর্ণকাররা এখন স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কর্মচারী হিসেবে কাজ করে। এ-ব্যবসায়ে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন বিধায় স্বর্ণকাররা এখন নিজস্ব ব্যবসা পরিত্যাগ করেছে।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment