বস ম্যানেজমেন্ট | ক্যারিয়ার ম্যানেজমেন্ট | শামস্ বিশ্বাস : অফিস নামক প্রতিষ্ঠানে বস ছাড়া গতি নেই। বস মানেই গম্ভীর এক ব্যক্তি যার সাথে কথা বলতে হয় বুঝেসুঝে। বস মানেই বকুনি আর কদাচিৎ কিছু প্রশংসা। বা কাজের ফিরিস্তি ধরিয়ে দেয়া লম্বা লিস্ট। তার হাতেই ক্ষমতা রয়েছে আপনার স্যালারি প্যাকেজ কী হবে, ছুটি মঞ্জুর হবে কি না। আপনার চাকরির মেয়াদটাও তাঁর হাতে। বসের হাতেই উন্নতির চাবিকাঠি। তাই বসকে খুশি রাখতেই হবে। জানতে হবে তার সম্পর্কে।
Table of Contents
বস ম্যানেজমেন্ট
বস কত প্রকার ও কী কী ?
মনেরমত বস:
হালকা মেজাজের মজার মানুষ! এমন বস উপরওয়ালার আশীর্বাদ। এই বসেরা আপনাকে নিজের মতো কাজ করার সুযোগ দেন। ইমোশনাল কথাবার্তা বলে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। এমন কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, যার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নেই। যদি দরকার পড়ে আপনার দোষ উনার উপরে চাপিয়ে দিতে পারবেন। তবে আপনার ব্যর্থতার দায় উনার ঘাড়ে উপর পড়বে না। এই ধরণের বসের সুবিধা নিয়ে, খুব বেশি উচ্চাকাঙ্খী হয়ে পড়বেন না।
নিজের মত বস:
এই ধরণের সব একেবারে আপনার মত হয়। আপনি যে ভাবে কাজ করতে পছন্দ করেন, উনিও তাই। আপনার যা ভুল হয়, উনারও তাই। অর্থাৎ, আপনি বস হলে যা যা করতেন, উনি তাই করেন। এই ধরণের বসের সুবিধা হল আপনার মাথায় যে যে আইডিয়া আসছে, তা উনার মাথায় ঢুকিয়ে দিন। উনার অবশ্যই ভালো লাগবে। কারণ উনি তো আপনার মতো। এই ধরণের বস পেলে সুযোগের সৎব্যবহার করুন। তবে একটু দূরত্ব রাখুন কারণ খুব বেশি আইডিয়া ডিসকাস করবেন না। দু’জনের মত মিলে যাবে। তাতে আপনার আত্মবিশ্বাস এত বেড়ে যাবে, আপনি উড়তে শুরু করবেন। যা আপনার পেশা এবং ক্যারিয়ারের জন্য ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
চতুর বস:
এই ধরণের বস আপনার কাজ সম্পর্কে আপনার চেয়ে অনেক ভালো জানেন। আপনি তাঁকে পছন্দ করেন কী করেন না, তা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার সামনে থেকে পারতপক্ষে পালিয়ে বাঁচুন। তার সামনে ওভার স্মার্টনেস দেখালেই আপনি আহাম্মক বনে যাবেন। তাকে হারানোর চেষ্টা বৃথা। আপনি ‘শের’ হলে তিনি ‘সোয়া শের’। তাই তার সঙ্গে দ্বিমত রাখবেন না। বোকাবোকা হয়ে চলবেন।
পরিশ্রমী বস:
প্রতিভাবান এই মানুষ এককথায় কাজ পাগল। নিজে যেমন খাটতে পারে অন্যদের থেকে ঠিক তাই আশা করেন। তবে, প্রতিষ্ঠানের ভালো কীসে হবে, তা উনি ছাড়া আর কেউ বোঝেন না। সেই মত পাল্টাতেও পারে। কারণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা একমাত্র তারই। এই ধরণের বসের সামনে সব সময় মাথা নিচু করে থাকুন। কাজ করুন। অপ্রয়োজনীয় কথা একদম বলবেন না। অ্যাটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করবেন না। উনি সেটাতে রেগে যেতে পারেন। কোনও ষড়যন্ত্র করবেন না তার বিরুদ্ধে। কারণ, উনি কিন্তু সব জানেন। বরং, বসের কাছের লোকদের এমন ভাবে প্রভাবিত করুন যাতে তারা আপনার সম্পর্কে তার কাছে ইতিবাচক কথা বলে।
যে ভাবে বসকে ম্যানেজ করবেন:
কমবেশি সবাই একই অভিযোগ করেন তা হল, হল বসের সাথে বনিবনা হয় না। বস আমাকে দেখতে পারেনা, বস আমার উপর অত্যাচার করে, বসের সাথে আমার শত্রুতা আছে এমন কথা হরহামেশাই বলতে শোনা যায়। বসকে পটানো কি এতোটাই অসাধ্য কাজ? নাহ, মোটেই না। বসেদের হাতে রাখা যায় সে ব্যাপারে অল্প-বিস্তর জ্ঞান সকলেরই রয়েছে। রইল কিছু পরামর্শ।
- আপনার চারপাশে সুনামি হয়ে গেলেও নিজের মাথা সব সময় ঠাণ্ডা রাখুন। বসেরা সব সময় তাঁদের উপরেই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যারা ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে পারেন।
- বসের মন জিততে তার প্রতিষ্ঠানের সুনাম করুন। আর তিনি যদি প্রতিষ্ঠানের মালিক বা উদ্যোক্তা হয়ে থাকেন তাহলে তো কথাই নেই। নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানের সুনাম শুনে কে খুশি না হয়ে পারে! তবে, তোষামোদি আর প্রশংসার মধ্যে পার্থক্য মাথায় রাখুন। বেশি বেশি করে গুণগান করলে বুঝতে পারেন আপনার আসল উদ্দেশ্য কী। সেক্ষেত্রে বস আপনাকে এড়িয়ে চলতেও পারেন। তাই মেপেঝুপে প্রশংসা করুন।
- প্রতিদিন সময় মত কাজে উপস্থিত থাকুন। দেরি করে অফিসে ঢুকবেন না। মাসে এক-আধ দিন দেরি করে এলে কিছু হবে না কিন্তু প্রতিদিন দেরি করে ঢুকলে বস মুখে কিছু না বললেও লংটার্মে তার প্রভাব পড়তে পারে। বস যেমনই হোক না কেন, সময় মত কাজে আসা কর্মীকে সে ফেভার করবেই।
- যখন-তখন ছুটি নিবেন না। ঘন ঘন ছুটি নেওয়া কোনও বসই পছন্দ করেন না। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ছুটি নেবেন না। চেষ্টা করবেন, হাফ-ডে লিভ নিতে। আপনি যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অফিসে আসার চেষ্টা করেন সেটা বোঝান।
- অফিসে বসে যারা দীর্ঘ সময় ব্যক্তিগত ফোনে কথা বলেন যান, তাঁদের নাম কখনও বসে গুডবুকে উঠে না। খুব দরকারি ফোন এলে ঘরের বাইরে গিয়ে কথা বলুন। বেশিক্ষণ কথা বলাটা খুব জরুরি হলে অনুমতি নিন।
- বস সব সময়ই ভ্যালুয়েবল রিসোর্স। শুধু টিমের কাজ নয়, নিজে সমস্যায় পড়লেও তার কাছে যান। তার কাছে দুর্বলতা বা সমস্যা আড়াল করলে সমস্যা বাড়ে বই কমে না। আপনার জায়গায় উনিও এক সময় ছিলেন। তাই উনার অভিজ্ঞতা দিয়ে সমস্যার সমাধান হতে পারে। এর সাথে সাথে বসেরও মনে হবে যে কর্মী হিসেবে আপনি উনাকে ভরসা করেন৷
- যখন কোনও দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপার আসে তখন অন্যদের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই কাজের ভারটি নিন। সাধারণত, নিজে থেকেই দায়িত্ব নিতে পারে এমন মানুষকেই বসরা পছন্দ করেন। আবার ধরুন, আপনার মাথায় কোনও প্রোডাকটিভ প্লান বা নতুন বিজনেস আইডিয়া এসেছে কিংবা কোনও কাজ অন্যদের আগে সেরে ফেলেছেন? তখন সহকর্মীদের অপেক্ষা না করে চেষ্টা করুন সবার আগে নিজেকে উপস্থাপন করার। এতে বস আপনার দক্ষতা বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করবেন এবং আপনাকে পছন্দ করবেন।
- বেসিক ব্যাপারটায় খেয়াল রাখুন – বসের সাথে যতই ফ্রি হোন না কেন, আপনার কাজেকর্মে যেন কোনও ভুল-ত্রুটি না থাকে। উদোমেরও যেন ঘাটতি না থাকে। শুধু বস নয়, সহকর্মীদেরকেও আপনার কাজ নিয়ে আঙুল তোলার সুযোগ দেবেন না। সুযোগ পেলেই বসের সাথে আলোচনা করুন কীভাবে আরও ভাল কাজ করা যায় তা নিয়ে ।
- অফিসের বসের সাথে সব সময় ভদ্র আচরণ করার চেষ্টা করুন। কারণ অভদ্র কিংবা অবাধ্য কর্মীকে বস পছন্দ করেন না। বস কোনও কাজের আদেশ দিলে সেটা সম্ভব হলে করার চেষ্টা করুন। আর যদি আপনার কোনও অসুবিধা থাকে সেটা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন। উচ্চ স্বরে কিংবা অভদ্র ভাবে কিছু বলা থেকে বিরত থাকুন। যদি আপনার বস আপনাকে অনেক অত্যাচার করে কিংবা অহেতুক কাজ চাপিয়ে দেয়া। এমন হলে, যতই মেজাজ খারাপ হোক, কখনই সেটা সবার সামনে প্রকাশ করবেন না। বসের সাথে চেষ্টা করুন সব পরিস্থিতিতে ইতিবাচক ও মিষ্টি ব্যবহার করার। এতে আপনার বস আপনাকে অবশ্যই পছন্দ করবেন।
- ক্যারিয়ারে নিয়ে আপনি কতটা সিরিয়াস সেটা বসের সামনে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ করুন। কর্মজীবনে উন্নতি সাধন যে আপনার লক্ষ্য, তার ব্যাপারে আলোচনা করুন। ভবিষ্যতে কোন পদে কাজ কতে চান – সেই ইচ্ছের কথা বলুন। তার অধীনে কাজ করে আপনি যে স্কিল অর্জন করেছেন, তা জানান তাকে। এই অভিজ্ঞতা আপনি পরবর্তীকালে কীভাবে কাজে লাগিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তা নিয়ে আলোচনা করুন। বসের পরামর্শে বাড়তে পারে আপনার কনফিডেন্স। এমন কি তাঁর নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে আপনি পেতে পারেন গোল্ডেন অপরচুনিটি।
- ক্লায়েন্ট মেইল এবং ইন্টারনাল মেইল, যিনি খুব ভাল মেইল লিখতে পারেন, বসেরা তাঁদের খুবই পছন্দ করেন। তাই মেইল লেখার এক্সপার্ট হয়ে যান। এই দক্ষতা দেখে খুশি হয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেল আপনাকে লিখতে বলেন তবে বুঝবেন বসের কাছের লোকের লিস্টে আপনি উঠেগেছেন।
- নিজের কাজ নিয়ে কিংবা স্যালারি নিয়ে বসের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে অসন্তোষ প্রকাশ করবেন না। আপনি যদি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে তাকে মাঝে মাঝে সে কথা জানাতে পারেন। কিন্তু প্রতিদিন স্যালারি হাইকের আওয়াজ বিরক্তিকর।
- অফিস পলিটিক্স, কর্মীদের মধ্যে গ্রুপিং সব সময় ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে এ সবের মাত্রা বেড়ে গেলে অফিসের কাজের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। অফিসে কাজ করতে এসেছেন। সে-টাই করুন। চেষ্টা করুন গ্রুপিং-পলিটিক্সে একবার জড়িয়ে ফেললে – সহজে বের হতে পারবেন না। তখন বসের নজরে আপনি ‘বিদ্রোহী’ কিংবা ষড়যন্ত্রকারী।
শেষ পরামর্শ: আপনার বস খুব বোকা, হয়তো অসম্ভব চালাক কিংবা ভয়ঙ্কর রাগি অথবা প্রচণ্ড ভালো মানুষ? সে যেমনই হোক না কেন – সবার প্রথমে সে আপনার কাজ দেখবে। আপনি যদি শতভাগ উজাড় করে পারফেক্ট কাজ করতে পারেন। সে আপনার হাতের মুঠোই থাকবে।
আরও পড়ুন: